নিজস্ব প্রতিনিধি: অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালী যাবার সময় ভূমধ্যসাগরে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার চার যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছে আরও একজন। শুক্রবার দুই যুবকের মৃত্যুর খবর পেয়ে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। এর তিনদিন পর আজ (মঙ্গলবার) আরও দুইজনের মৃত্যুর খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন স্বজনরা। সংসারের কর্মক্ষম সন্তানদের হারিয়ে দিশেহারা তাদের পরিবার। এই ঘটনায় দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। আদরের সন্তান আর কোনদিন ঘরে ফিরবে না,এই শোক কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। তাদের আহাজারীতে ভাড়ী হয়ে উঠেছে চারপাশের পরিবেশ।
জানা যায়,গত ২ মাস আগে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২০), সেন্দিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২৫),কবিরাজপুর ইউনিয়নের কিশোরদিয়া গ্রামের মৃত তোঁতা খলিফার ছেলে কায়সার খলিফা(৩৫) ও বাজিতপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজীসহ(১৮) বেশ কয়েকজন যুবক ইতালীর উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। পরে গত বুধবার লিবিয়া থেকে ইঞ্জিনচালিত ছোট একটি নৌকায় ইতালীর উদ্যেশ্যে গেম দেয় তাদের। ৩২জন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন নৌকায় ৫২জন যুবককে নিয়ে ইতালী যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার ভুমধ্যসাগরে নৌকার ইঞ্জিন ফেটে আগুন ধরে যায় নৌকায়। এতে মামুন,সজল,কায়সার,সজীবসহ মারা যায় ৯ জন। পরে খবর পেয়ে বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড। এছাড়া এখনো নিখোঁজ রয়েছে একই উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের উত্তর কদমবাড়ি গ্রামের পরিতোষ বিশ^াসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২০)।
নিহত সজীব কাজীর বাবা মিজানুর রহমান কাজী জানায়,গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের গজনিয়া গ্রামের রহিম দালালের সাথে ১৪ লাখ টাকা চুক্তি হয়। রহিমের ভাই কামাল আমার কাছ থেকে নগদ ১২ লাখ নিয়ে আমার ছেলেকে লিবিয়া পাঠায়। পরে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালী পাঠানোর সময় ঘটে এই দুর্ঘটনা। শুনেছি আমার সজীব আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিল। দুইদিন পরে মৃত্যুর খবর পেয়েছি।
নিহত কায়সার খলিফার স্ত্রী নাজমা বেগম জানায়, রাজৈরের পাইকপাড়া ইউনিয়নের দামেড়চর গ্রামের অবুঝ মাতুব্বর প্রথমে সাড়ে ৮ লাখ টাকা চুক্তিতে লিবিয়া নেয়। পরে বড় ইঞ্জিন চালিত নৌকায় দেয়ার কথা বলে আরো সাড়ে ৪ লাখ টাকা নিয়ে ছোট একাটি নৌকায় পাঠালে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে আমার স্বামী মারা যায়। সব কিছু বিক্রি করে এবং সুদে টাকা এনে স্বামীকে বিদেশে পাঠানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন আমার সবই শেষ হয়ে গেল। আমার দুটি মেয়ে নিয়ে কিভাবে বাঁচবো।
নিখোঁজ নয়ন বিশ্বাসের ভাই আকাশ বিশ্বাস জানায়,আমার ভাই ঢাকার এক দালালের মাধ্যমে লিবিয়া গিয়েছিল। পরে এ দুর্ঘটনার খবর শুনেছি। কিন্তু দালালের সাথে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। সে বলেছে আমার ভাই ভাল আছে।
নিহত মামুন শেখের বড় ভাই সজিব শেখ জানায়, মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে নেয় ১৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেয়। পরে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালী পাঠানোর সময় ঘটে এই দুর্ঘটনা।
নিহত সজল বৈরাগীর পিতা সুনীল বৈরাগী জানায়, আমি গরীব মানুষ। টাকার লোভে ছেলেকে স্বপ্নের দেশ ইতালি পাঠাতে চেয়েছিলাম। জমিজমা বিক্রি করে দালালের কাছে টাকা দিয়েছি। এখন আমার সবই শেষ হয়ে গেল।
সরকারীভাবে তাদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন নিহতের স্বজনরা। এই ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত দালাল মোশারফ কাজী দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়া বসবাস করছে। তার ছেলে যুবরাজ গ্রাম থেকে ইতালী পাঠানোর জন্য যুবকদের সংগ্রহ করতো বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সরকারীভাবে তাদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন নিহতের স্বজনরা। এই ঘটনার অভিযুক্ত দালালরা দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়া ও ইতালিতে বসবাস করায় তাদের পরিবারের লোকজন এখান থেকে টাকা সংগ্রহের কাজ করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান হাওলাদার আসাদ জানান, এ ব্যাপারে এখনো কেউ অভিযোগ করেনি। নিহতদের পরিবার থেকে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম জানান,তিউনিসিয়ার ভুমধ্যসাগরে মাদারীপুরের ৫জনসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি মারা গেছে।এই ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।