মোশাররফ হোসেন : ঈদ আনন্দ চলছে ঘরে ঘরে। কোকিল ডাকা ভোরে, সূর্য ওঠার আগে বাংলাদেশ জুড়ে আজ ইসলাম ধর্মের মানুষ ঘুম থেকে উঠেছে ।তিরিশটি রোজার শেষে খুশির দিন ঈদ উল ফিতর। এ দিনটির ধর্মীয় বর্ণনায় গেলামনা। তবে আনন্দ, উৎসবে রূপ নেবার বিভিন সামাজিক বিষয় দেখার ৬০ বছরের ঘটনাক্রম নিয়ে এ লেখা।
সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব এবং অসামপ্রদায়িক চেতনার শ্বাশ্বত রূপ বিবর্তনের ধারায় আজও গ্রাম বাংলাজুড়ে চলছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শেকড় অনেক গভীর । হাজার বছরের আবহমান বাংলায় যা চির ভাস্বর । কী দেখেছি সেই ষাটের দশকে ?
বরিশালের গৌরনদী – আগৈল ঝাড়ার গইলা গ্রামে বসবসাকারি দীর্ঘদেহী আরবী ও পারসী ভাষা জানা আমার দাদাজান আবদুস সাত্তার ১৯৬৪ সালে বলতেন, নাতি ২৯/ ৩০ রোজা শেষে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। ঈদের দিন সকালে সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে
উঠতে হবে । এরপর গইলা উচ্চ বিদ্যালয় মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে আঊশ চাল ও খেজুরের গুড়ের পায়েস খেয়ে তোমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরব। আমার আনন্দ আর দেখে কে। মা ঠিকই দাদা ও নাতির সখ্যতা লক্ষ্য করে আমাকে ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিতেন।
আবার ৫ গ্রামের একটি ঈদগাহতে ঈদের নামাজ পড়তে জায়নামাজ হাতে নিয়ে দাদা ও বাবাকে অনুসরন করেছি। নামাজ শেষে লাইন দিয়ে ঈদের কোলাকুলি ও সালাম করার টাকা নিয়ে আনন্দে বাড়ি ফিরেছি। পায়েস ও সেমাই খেয়ে সে কী গল্প। তখন গৌরনদী -আগৈলঝাড়া -কোটালিপাড়ার রাস্তা ছিল কাঁচা। এখন এ রাস্তা মহাসড়ক। আমাদের বড় পরিবার। তখন আমরা তিন ভাই দু বোন। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে সংখ্যা দাড়ায় ৫ ভাই ও ৪ বোন।
১৯৬৬সাল থেকে আমার বাবা, রেলওয়ে কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক এর কর্মস্থল চট্টগ্রামে বসবাস শুরু করেছিলাম। বাবা ১৯৩৭সালে কোলকাতায় আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে চাকুরি শুরু করে ১৯৪৪ সালে চট্টগ্রামে সিআরবিতে বদলি হয়ে আসেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়া শুরুর পর ঈদে চট্টগ্রামের রেলওয়ে পলোগ্রাঊন্ড মাঠে বিশাল সমাবেশে নামাজ পড়েছি । বন্ধুদের বাসা ও বাড়িতে বেড়িয়েছি। বিশেষ রকমের খাবার খেয়ে রিকশা ও গাড়িতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছি।
এসএসসি পরীক্ষা শেষে কোলকাতা বেড়িয়ে আসি ১৯৭২ সালে। আজও সে বন্ধুত্ব অটুট । চট্টগ্রাম কলেজে ১৯৭২ সালে ঊচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ার সহপাঠিরা মিলে সাংস্কৃতিক সংগঠন “এক ঝাঁক পায়রা” গড়ে মহান একুশ ,স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন ও কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। আবার দূর্গপুজার সময় উৎসবে যোগ দেয়া ও বিজয়া দশমীতে পারিবারিক ভোজে আমরা অংশ নিয়েছি। এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল বড় বিষয়। ঠিক একইভাবে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে চড়ে
চাদপুর হয়ে বরিশালগামি গাজী রকেটে বরিশাল। বাসে গৌরনদী পৌছে, কাঁচা রা¯তায় রিকশায় করে গইলার বাড়ি। তখন গাজী স্টিমারে পদ্মার ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া আজও ভুলিনি। আবার গইলা থেকে নৌকায় চড়ে গৌরনদী, হোসনাবাদ হয়ে
নন্দীর বাজার গিয়ে গাজী স্টিমারে চাদপুর। মেঘনা নদী অতিক্রমের সময় নৌকায় তাজা ইলিশ মাছ রান্না ও খাওয়া ছিল নৌকা ভ্রমণের জীবন্ত বিষয়।
শুধু কী তাই। বরিশাল গেলে ঈদ যেন উৎসবে রূপ পেত। নামাজ ,খাওয়া ও বেড়ানোর মধ্যে আনন্দের বিষয় ছিল। করিম ও রুস্তম মামা গইলা এসে নৌকায় করে মামা বাড়ি নিয়ে যেতেন। আবার ফিরিয়ে আনতেন। পথে ধান ও পাটক্ষেতের লাল শাপলা নিয়ে আসতাম।
সর্বোপরি ঈদ উৎসবে গইলায় নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। নাটক পরিচালনাকরতেন আমার বাবা। অভিনয় করতেন বাবা, চাচা মিয়া জলিল ,নবী ফুফা , ফণী মাস্টার ,মিহির দাশ গুপ্ত,আশীষ দাশ গুপ্ত, মতিয়ার রহমান তালুকদার, মানিক তালুকদার, মোবারক প্রমুখ। গান গাইতেন নিরনজন, সুনিল কাকা সহ অনেকে।
ঈদের দিনে বিকেলে খাওয়া শেষে আমাদের বাড়িতে কবিতা ও গানের আসর হতো। আমাদের এলাকায় সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি আজও অটুট আছে। ঈদ ও দূর্গাপুজার উৎসব, আনন্দে কাটে। নাটক কবিতাসহ উৎসব, জাতীয় দিবস পালিত হয়। কারো
বাড়িতে সামপ্রদায়িক সহিংসতা করার দু;সাহস কেউ দেখায়না ।বাংলাদেশের সর্বত্র এটা আশা করি।
কানাডা ,যুক্তরাস্ট্র, ইউরোপ ,মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকাসহ বিশ্বজুড়ে এখন ঈদ উৎসবে মেতে আছেন বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের সর্বত্র বিদুতের ছোাঁয়া লেগেছে।
পদ্মা সেতুতে চলাচল শুরু হলে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জীবন বদলে যাবে। সাড়ে তিন ঘন্টায় বরিশাল, পটুয়াখালী ও ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ পৌছে যাবে গাড়ি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে মানুষের আয় বাড়বে।
আধুনিক প্রযুক্তি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ বেড়েছে বিশ্বজুড়ে। ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবে ভারচুয়াল ভিডিওর আলোচনা ও আনন্দে মেতে উঠছেন সবাই। এটা বাংলাদেশের অগ্রগতি। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ।