মালিকুজ্জামান কাকা, যশোর : যশোর বা দক্ষিনাঞ্চল নয়, সেই সুদুর বান্দরবনে তিনি কাজু বাদামের চারা উৎপাদন ও ফলনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন।
এই সফল কৃষি উদ্যোক্তা হলেন, যশোরের মনিরামপুর উপজেলার বলিয়ানপুরের মৃত পুত্র মৃত ভাষা সৈনিক নুরুল হকের পুত্র ইফতেখার সেলিম অগ্নি। তিনি ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে উচ্চ ফলনশীল এম-২৩ জাতের কাজু বাদাম চারা সংগ্রহ করে তার প্রতিষ্ঠান এল এ এগ্রো লিমিটেডের মাধ্যমে এসব চারা সারা দেশে সরবরাহ করছেন।
ইফতেখার সেলিম অগ্নি। তার পরিচিতি ছিল গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। করোনায় গার্মেন্টস শিল্পে ধ্বস নামায় তিনি কৃষি খাতে সম্পৃক্ত হন। ভিন্ন মাত্রার কৃষি পণ্য হিসাবে তিনি উচ্চ ফলনশীল কাজু বাদাম চাষাবাদ শুরু করেন।
ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে এম-২৩ জাতের উচ্চ ফলনশীল কাজু বাদামের চারা সংগ্রহ করেন। একই সাথে এর চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে তিনি ব্যাপক মাত্রায় চারা উৎপাদনের কার্য্যক্রম শুরু করেন। বান্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা জারুলিয়া ছড়ি, নাইক্ষিংছড়ি ও সয়ালেকে পাহাড়ের ঢালে এখন ব্যাপকভাবে কাজু বাদাম চাষ হচ্ছে। বলা যায় তা সাড়া ফেলেছে ব্যাপক মাত্রায়। শুরুর মাত্রা ধরে রাখতে পারলে আগামী কিছু দিনে আমদানি অর্থাৎ পর নির্ভারতা কমে বাদামে স্বয়ংসম্পুর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে।
সমতলে কাজু বাদামের চারা রোপণের প্রথম বছরে ফলন শুরু হয়। প্রথমে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে ৫ লক্ষ বীজ আনেন কৃষি উদ্যোক্তা ইফতেখার সেলিম অগ্নি। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার বীজে চারা গজায়। বাকিটা মিস্ধসঢ়; হয়।
২০২১ সালে ১জুন কৃষি মন্ত্রী ড.আব্দুর রাজ্জাক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় সচিবসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা কাজু বাদামের ক্ষেত পরিদর্শন করেন। বান্দরবন জেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. নাজমুল হক কাজু বাদাম ক্ষেত ও উৎপাদন ব্যবস্থা পরিদর্শন করেন প্রায়। এখন এলএ এগ্রো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইফতেখার সেলিম অগ্নি সারা দেশে কাজু বাদামের চারা সরবরাহ করছেন। কৃষি মন্ত্রনালয়ও তার থেকে চারা ক্রয় করছে। এটি এই উদ্যোক্তার জন্য ভালো দিক। শীত মৌসুম অর্থাৎ সেপ্টেম্বর হতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কাজু বাদাম বীজ থেকে চারা অঙ্কুরায়ন হয়। সমতল
ভূমিতে সারা বছর চারা রোপন করা যায়। তবে পাহাড়ে বর্ষায় কাজু বাদামের চারা রোপন হয়।
শুধু কাজু বাদাম নয় ইফতেখার সেলিম অগ্নি ও তার প্রতিষ্ঠান এলএ এগ্রো লিমিটেড এ্যাভোকাডো, চুঁইঝাল, সজনে চারা ব্যাপকভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ করছে। এজন্য তিনি প্রতি বছর ৪০০ মে:টন জৈব সার তিনি ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ তিনি নিরাপদ কৃষি উৎপাদনে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
আশার কথা এই, জৈব পন্থায় কৃষি উৎপাদন নিশ্চিতকরনে ইফতেখার সেলিম অগ্নি মনিরামপুর নিজ এলাকায় ৪০ শতক জমিতে দীপ্ত, ভার্মি ফার্টিলাইজার অর্থাৎ কেঁেচাসার খামার গড়েছেন। ক্ষতিকারক রাসায়নিক সারের পরিবর্তে তিনি নিরাপদ জৈব পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদনে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছেন। এর মাধ্যমে জমি ও মাটি রক্ষায় তিনি নিবেদিতপ্রাণ কৃষক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। এটিও তার আরেকটি কৃষি সফলতার গল্প।
এলএ এগ্রো লিমিটেডের ম্যানেজার আবু জাফর জানান, চলতি ২০২২ সালে এখনো পর্যন্ত চার লক্ষ কাজু বাদামের চারা তৈরি হয়েছে। প্রতি পিস ১৫০ টাকা মূল্যে এই চারা বিক্রি হচ্ছে। আশা এই, এম-২৩ কাজু বাদাম চারা রোপনের ৭/৮ মাসের মাথায় সকল গাছে মুকুল এসেছে। ফলে এদেশের আবহাওয়া ও মাটি কাজুবাদাম চাষে অতি উপযোগী। উৎপাদিত চারায় বান্দরবান নাইখ্যাংছড়ির দীপ্ত ক্যাশুস্টেটে রোপনকৃত চারার গ্রোথ ও সকল গাছে মুকুল এসেছে। দেশে প্রায় ৭০০ মে: টন কাজু বাদাম উৎপন্ন হয়। প্রক্রিয়াজাত অভাবে খোসাসহ বাদাম বিদেশে রপ্তানি হয়। প্রয়োজনে বেশি দামে কাজু বাদাম আমদানি হয়।
১কেজি প্রক্রিয়াজাত করা কাজু বাদামের মূল্য প্রায় ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা। ১কেজি প্রক্রিয়াজাত করা বাদাম পেতে প্রায় ৩.৫ -৪ কেজি
খোসাসহ কাজু বাদাম প্রয়োজন। এর দাম ৩০০-৪০০ টাকা। আধুনিক মেশিনে প্রক্রিয়াজাত হলে বাদামের বাণিজ্যিক মূল্য বেড়ে যায়। তখন
প্রয়োজন মিটিয়ে বেশি মূল্যে বিদেশে রপ্তানি হবে। এতে দেশের বৈদিশিক মুদ্রা উপার্জন ও কর্মসংস্থান হবে। রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ভিয়েতনাম বছরে ১৫ লাখ টন কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি করে। নিজ উৎপাদিত কাঁচা কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করেও রপ্তানি করে।
বাংলাদেশ ২০১০-১১ অর্থবছরে কাঁচা কাজুবাদাম রপ্তানি শুরু। এরপর কৃষক চাষে আগ্রহী হন। ২০১৮ সালে ৯৬২ টন, ২০২০ সালে ১৩২৩ টন। ৩ বছরে ফলন বেড়েছে ৩২ শতাংশ। বান্দরবানে ৮,৬৯,০০০ কাজুবাদাম গাছ আছে। খাদ্য মানে কাজু বাদাম অতি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর। এতে শতকরা ২১ ভাগ আমিষ, ৪৭ ভাগ ¯েœহ, ২২ ভাগ শর্করা, ২.৪ ভাগ খনিজ পদার্থ, ০.৪৫ ভাগ ফসফরাস, ০.৫৫ ভাগ ক্যালসিয়াম এবং প্রতি ১০০ গ্রাম বাদামে ৫ মিলিগ্রাম লৌহ ৭৩০ মি:গ্রাম ভিটামিন বি-১, ১১০ মি:গ্রাম রাইবোফ্লোবিন রয়েছে।
প্রচুর শর্করা, আমিষ, খনিজ পদার্থ, ভিটামিনসহ স্কাস্থ্যে নানা উপকারী ফাইটো ক্যামিক্যালস রয়েছে। কাজুবাদাম ১। হৃৎপিন্ডে শক্তিদায়ক ২।
হাড় ও দাঁত গঠনে সহায়ক ৩। ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ৪। হজমে সাহায্যে করে ৫। চুলের উপকার করে ৬। পিওথলি/কিডনি পাথর তৈরিতে বাধা দেয় ৭। ভালো ঘুম হয় ৮। ¯œায়ুতন্ত্রকে সুস্থ সবল করে ৯। বøাড প্রেসার কমায় ১০। ডায়বেটিস রোগীর জন্য উপকারী ১১। রক্ত শূন্যতা কমায় ১২। অবসাদ দূর করে ইত্যাদি। এতে পুষ্টি পদার্থ যেমন তামা, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা, ফসফরাস, আয়রন, সেলেনিয়াম, থায়ামিন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিপদার্থ ভিটামিন কে, ভিটামিন বি-৬ রয়েছে। ১ আউন্স বা প্রায় ২৮.৩ গ্রাম কাজু বাদামে ১৫৭ গ্রাম ক্যালরি, ৫.১৭ গ্রাম প্রোটিন, ১২.৪৩ গ্রাম ফ্যাট, ৮.৫৬ গ্রাম শর্করা, ০.৯ গ্রাম ফাইবার, ১.৬৮ গ্রাম চিনি হয়। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাজুবাদামের ব্যাপক চাহিদা। ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ’র ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আগ্রহে প্রকল্প ১৯ জেলায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য তালিকায় বৃক্ষ ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে কাজু বাদাম ৩য়। বাদাম জাতীয় ফসলে তা ১ম স্থানে। এখানে কৃষক কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাত না করেও বাদাম বিক্রি করে টন প্রতি মূল্য প্রায় ১,০০,০০০ থেকে ১,২০,০০০ টাকা। সামান্য পরিচর্যায় ১ হেক্টর থেকে ১.৫ থেকে ১.৮ টন হয়। মন্ত্রী পরিষদ বাংলাদেশে জৈব কৃষিনীতি অনুমোদন করেছে। বাদাম জৈব উৎপাদনে দেশে ও বিশ্ব বাজারে ভালো দামে বিক্রি করা যাবে। বিশ্ব বাজারে জৈব ফসলের চাহিদা ব্যাপক। কাজু বাদাম উৎপন্ন হলেও প্রক্রিয়াজাত অভাবে খোসাসহ বাদাম বিদেশে রপ্তানি হয়।
বিদেশ বাজারে এর প্রচুর চাহিদা। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত কাজু বাদাম আমদানি করে। তবে আধুনিক মেশিনে প্রক্রিয়াজাত হলে তার মূল্য বাড়বে। আকর্ষণীয় মূল্যে বিদেশে রপ্তানি হবে। এতে দেশের অতিরিক্ত বৈদিশিক মুদ্রা উপার্জনের সাথে কর্মসংস্থান হবে। বড় বাদাম জাত, ফলন ভালো বাদামের গ্রাফটিং চারা ভালো। ১ কেজি কাজু বাদামে ১৮০ বীজ হলে গ্রেড-অ এবং ১৮১ থেকে ২১০ বাদামে ১কেজি হলে গ্রেড-ই, ১ কেজিতে ২১০ এর বেশি হলে গ্রেড-ঈ মূল্য কম। বড় বাদাম হয় এমন চারা রোপন করতে হবে।
কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাত ফ্যাক্টরি স্থাপন হলে বাদাম ছাড়া অন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য মেলে। ১। কাজু জুস : কাজু বাদামের উপরে কাজু ফল বা আপেল থাকে। এতে প্রায় ৮০ শতাংশ জুস থাকে, যা ঔষধিগুণ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। এতে কমলা লেবুর চেয়ে ৬ গুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। কাজু থেকে উৎপাদিত কাজু জুস দিয়ে পুষ্টিহীনতা দূর হয়। ২। ঈঘঝখ : কাজু বাদাম শেল বা খোসায় উৎপাদিত তেলে উৎকৃষ্ট জৈব বালাইনাশক উৎপাদন হবে, যা নিরাপদ ফসল ও খাদ্য উৎপাদনে জরুরি।
এছাড়া মানবদেহ ও পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক আমদানি না করে প্রতিহত করে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। বাদাম খোসার তৈল শিল্পে মূল্যবান দ্রব্য। পেইন্টিং ফ্যাক্টরির মূল্যবান কাঁচামালে ব্যবহৃত হয়। ৩। জৈবসার : কাজু আপেল থেকে জুস বের করার পর যে মন্ড বা ছোবরায় হাজার হাজার টন মাটির প্রাণ ভাল জৈবসার উৎপন্ন হবে। শেল বা খোসা তেল করার পর খৈল
দিয়ে হাজার হাজার টন জৈবসার হবে। দেশে সর্বত্র চাষযোগ্য ফলটি খাবার উপযোগী ২ অংশ থাকে কাজু ও বাদাম। পাকা কাজু আপেলের মতো রসালো, কাঁচা খাওয়া যায়। প্রক্রিয়াজাতকরণের পর অতি পুষ্টিকর বাদাম খাওয়া যায়।
কাজুবাদাম আমদানি ২০১৮-১৯ সালে ৫,৮০,০০০ কেজি, উৎপাদন ১০০০ টন। এর উৎপাদন, সংগ্রহ, শুকানো-সংরক্ষণে প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন। নারীর কর্মসংস্থান সুযোগ আছে। পাহাড়ের ঢাল ও সমতলে হেক্টরে ১৫০ থেকে ১৮০ চারা রোপণ যথেষ্ট। ১০-১২ বছরের গাছে বছরে গড়ে ১০/১২ কেজি কাঁচা বাদাম হয়। হাইব্রিড গাছে ফলন বেশি। ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি কাঁচা বাদাম বিক্রি দর। কাঁচা বাদাম রোদে শুকিয়ে বস্তাবন্দি করে ৭/৮ মাস ঘরে রেখে পরে বিক্রি করা যায়। পরিকল্পিত কাজু বাদাম চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
বিশ্বে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনাম ২০১৯ সালে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার কাজুবাদাম রপ্তানী করেছে। বাংলাদেশ ২০১৯-২০ সালে ভিয়েতনামে ও ভারতে তা রপ্তনি করে মাত্র ৩.৫৭ লাখ ডলার, যেখানে প্রস্তত বাদাম আমদানী করেছে ভিয়েতনাম থেকে ৮৫৭ টন। আমদানী-রপ্তানীর পরিসংখ্যানে কাজু বাদামের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বোঝা যায়। ২০২০ সালের উৎপাদন হিসাবে দেশে কাজু বাদাম ফলন প্রতি হেক্টরে ১.৩২৩ টন।