দেশের আপাতকালীন সময়ের জন্য সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহে ডিজিটাল রাইস প্রকিউরমেন্ট’ অ্যাপস-এর মাধ্যমে ধান-চালসহ খাদ্যশস্য সংগ্রহের শতভাগ লক্ষমাত্রা অর্জনের নজিরবিহীন সফলতা দেখিয়েছে খুলনা জেলা। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা জেলার ৯টি উপজেলায় ধান সংগ্রহের লক্ষমাত্রা ৯৬হাজার ৮৪৫মে.টন, সিদ্ধচাল ১৭হাজার ৯৪৮মে.টন ও আতপ চাল ২হাজার ৭৭৩মে.টন নির্ধারণ করা হয়। ইতিমধ্যেই ডিজিটাল প্রকিউরমেন্ট অ্যাপসের মাধ্যমে দালাল, মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও হয়রানীমুক্তভাবে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষমাত্রা শতভাগ অর্জন করে খুলনা বিভাগসহ দেশের মধ্যে মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ পদ্ধতিতে খাদ্যশস্য সংগ্রহের ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের নায্যমূল্য পেয়ে বেশী উপকৃত হয়েছে।
খুলনা জেলা ও ৯টি উপজেলা প্রশাসন এবং খাদ্য বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহনের ফলে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ ধান-চাল সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন জেলা প্রশাসন ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যেই খুলনার এ উদ্যোগ খাদ্য বিভাগসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। খুলনা জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগকে নজীরবিহীন হিসেবে উল্লেখ করে খুলনার এ ডিজিটাল অ্যাপস ভিত্তিক মডেলকে সারা দেশে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। শুক্রবার দুপুরে খুলনা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনলাইনে খুলনা জেলায় ‘ডিজিটাল রাইস প্রকিউরমেন্ট’ অ্যাপস-এর মাধ্যমে শতভাগ চাল সংগ্রহের সফল কার্যক্রমের সমাপনী অনুষ্টানে প্রধান অতিথির বক্তবে এ কথা বলেন। তিনি খুলনা জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যারা খাদ্য মজুত করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে বেশী লাভ করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও ঘোষনা দেন।
অনুষ্ঠানে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, ২০১৯ সালে দেশের ১৬টি উপজেলায় ডিজিটাল ভিত্তিতে খাদ্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল কিন্তু তার ফলপ্রসু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। খুলনা জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগে খাদ্য বিভাগ সারা দেশে প্রয়োগের চেষ্টা করবে। খাদ্য সংগ্রহের সময়ে করোনা, মজুতদারদের কারচুপি, ব্যবসায়ীদের অণেতিক লাভ করার প্রবনতা ও মজুতদারীসহ নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও একমাত্র খুলনা শতভাগ লক্ষমাত্রা পুরন করতে পেরেছে। সেজন্য তিনি মিলমালিকদের দাবী পুরন ও প্রনোদনা দেওয়ার কথাও জানান। খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে জুম অ্যাপের মাধ্যমে আরো সংযুক্ত ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ, খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ড. মুঃ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। এছাড়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসান, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ তানভীর রহমান, প্রেসক্লাবের সভাপতি জনাব এস এম নজরুল ইসলাম, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মুন্সি মো: মাহবুব আলম সোহাগ, মিল মালিক সমিতির সভাপতি মুহা: মুস্তফা কামাল ও সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুস সোবহানসহ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিভাগীয় খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, খুলনা বিভাগের ১০জেলায় ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৬হাজার ৮৪৫মে.টন। এরমধ্যে খুলনা জেলায় ১০হাজার ১৫১মে.টন, বাগেরহাট জেলায় ৬হাজার ৪১৮মে.টন, সাতক্ষীরায় ৯হাজার ২৮টন, যশোর ২৯হাজার ৫৬৬টন, ঝিনাইদহ জেলায় ১৪হাজার ১৪২টন, মাগুরায় ৪হাজার ৯৬৪টন, নড়াইল জেলায় ৮হাজার ৮১টন, কুষ্টিয়ায় ৬হাজার ৫৫টন, চুয়াডাঙ্গায় ৫হাজার ৩১০টন ও মেহেরপুরে ৩হাজার ১৩০মে.টন। বিভাগের ১০জেলায় চাউল সংগ্রহের জন্য খুলনা জেলায় সিদ্ধচাল ১৭হাজার ৯৪৮মে.টন ও আতপ চাল ২হাজার ৭৭৩মে.টন, বাগেরহাট জেলায় সিদ্ধচাল ৪হাজার ৭৯২মে.টন ও আতপচাল ৪৮৮মে.টন, সাতক্ষীরায় সিদ্ধচাল ১১হাজার ৪৪৩মে.টন ও আতপ চাল ১হাজার ২৫৮মে.টন, যশোর জেলায় সিদ্ধচাল ২৬হাজার ৭৭৭টন ও আতপচাল ১হাজার ৮২৬মে.টন, ঝিনাইদহ জেলায় সিদ্ধচাল ১৭হাজার ৬২২টন ও আতপচাল ৬৯৮মে.টন, মাগুরায় সিদ্ধচাল ৫হাজার ৬১৫ মে.টন, নড়াইল জেলায় সিদ্ধচাল ৪হাজার ৮৬টন ও আতপচাল ৩৭৪মে.টন, কুষ্টিয়ায় সিদ্ধচাল ৩৪হাজার ৬০২টন ও আতপচাল ১হাজার ৩৭৪মে.টন, চুয়াডাঙ্গায় সিদ্ধচাল ৭হাজার ৬০৫মে.টন ও মেহেরপুরে সিদ্ধচাল ১হাজার ৪৩৮মে.টনসহ সর্বমোট ১লাখ ৪০হাজার ৭১৯মে.টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। এছাড়া খুলনা বিভাগে গম সংগ্রহের জন্য ঝিনাইদহ জেলায় ১হাজার ৩৬৫টন, মাগুরায় ১হাজার ৪৫৩টন, নড়াইল জেলায় ৫১৬মে.টন, কুষ্টিয়ায় ৯১৩মে.টন, চুয়াডাঙ্গায় ৭৪মে.টন ও মেহেরপুরে ১হাজার ৮৮২মে.টনসহ সর্বমোট লক্ষ্যমাত্রা ৬হাজার ২০৩মে.টন নির্ধারন করা হয়।
খুলনা ডিজিটাল খাদ্যশস্য সংগ্রহ মডেলের প্রধান উদ্যোক্তা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন জানান, ‘ডিজিটাল রাইস প্রকিউরমেন্ট’ অ্যাপস-এর মাধ্যমে চাল সংগ্রহের কার্যক্রম জেলা প্রশাসনের একটি অন্যতম উদ্ভবনী উদ্যোগ। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সরকার নির্ধারিত ন্যায্য মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে ঘোষণা তা বাস্তবায়নে এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ী, দালালচক্র, মধ্যস্বত্ত্বভোগী নানা অনিয়মের মাধ্যমে ফায়দা লুটে নিচ্ছিলো। একই সাথে সরকারের খাদ্য সংগ্রহ কাযর্ক্রমে জটিলতা সৃষ্টি করে প্রান্তিক কৃষকদের হয়রানি ও কমমূল্যে ধান-চাল বিক্রিতে বাধ্য করতো। এই অবস্থার অবসানে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল অ্যাপের মাধ্যমে ধান-চাল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই লক্ষ্যে স্বচ্ছ ও সহজতর আর্থিক লেনদেন নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘Digital Rice Procurement’ নামক একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়। এ অ্যাপের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কৃষকদের নিকট
থেকে ধান-চাল ক্রয়ের জন্য মনিটোরিং ব্যবস্থাও নেয়া হয়। গত ৯মে খুলনা মহানগরীর মহেশ্বপাশা সিএসডি খাদ্য গুদাম চত্বরে কৃষকের হাসি মোবাইল অ্যাপস-এর মাধ্যমে প্রান্তিক চাষীদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয়ের এবং ১৮মে জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার খাদ্য গুদাম(এলএসডি গোডাউন)-এ মোবাইল অ্যাপস ‘Digital Rice Procurement’ এর মাধ্যমে ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষকদের নিকট থেকে চাল সংগ্রহের মাধ্যমে চাল ক্রয় কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। এ ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্যশস্য ক্রয়ে প্রান্তিক চাষীদের সাথে সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধির সরাসরি সংযোগ হওয়ায় মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ব্য হ্রাস পেয়েছে। কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের নায্য মূল্য পাওয়ায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, বিভাগের ১০জেলার মধ্যে খুলনা জেলার ৯টি উপজেলায় ধান সংগ্রহের লক্ষমাত্রা ৯৬হাজার ৮৪৫মে.টন, সিদ্ধচাল ১৭হাজার ৯৪৮মে.টন ও আতপ চাল ২হাজার ৭৭৩মে.টন নির্ধারণ করা হয়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং খাদ্য বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহনের ফলে লক্ষমাত্রার শতভাগ ধান-চাল সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে। এ পদ্ধতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে কৃষক যেমন নায্যমূল্য পাবে তেমনি সরকারের ব্যয় সাশ্রয় ও খাদ্যশস্য সংগ্রহ সহজতর হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।