আওয়ামী লীগের দশকী শাসনের শুরুর দিকের কথা। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর লেকের পাড়ে আমাদের এলাকার দুই বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা দল, সরকার নিয়ে কথা বলছিলেন। হঠাৎই তাদের সঙ্গে দেখা। কিছুক্ষণ তাদের কথা শোনার পর তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে দুটো কথা বলি। দু’জনেই খুব আশ্চর্য হয়ে যান। তোমরা, তরুণ প্রজন্ম তাজউদ্দীন আহমদের কথা জান?
হ্যাঁ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাঁর আদর্শিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সফল নেতৃত্ব ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাসে ঝলঝল করা এই নক্ষত্র নানাভাবেই মেঘে ঢাকা। এখনো তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ নেতাদের এই একজনকে তেমনভাবে চেনে না। তার অবদান সম্পর্কে জানে না। তরুণদের মধ্যে যারা তাঁর নাম জানে তা রাজনৈতিক পরম্পরার কারণে নয়, বিসিএসের জন্য এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর হিসেবে মুখস্ত করে। যারা প্রকৃত অর্থে তাজউদ্দীনকে জানেন তারা অনুষ্ঠান, সংগঠনে তাঁর নাম মুখে নেন না, কলম তো ধরেন-ই না। কিন্তু আড়ালে আবডালে মুখভরে তাজউদ্দীন আহমদের প্রশংসা করেন। তাদের মধ্যে কীসের সংকীর্ণতা জানি না। আজ ২৩ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, বাংলার শ্রেষ্ঠ অহংকারদের একজন- প্রিয় তাজউদ্দীন আহমদ।
রাজনীতিতে তাজউদ্দীন আহমদকে জাতীয় চার নেতার একজন হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। নিঃসন্দেহে জাতীয় চার নেতা দেশের সন্ধিক্ষণে তাদের কর্তব্য পালনে যে দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন তা অবিস্মরণীয়। তাজউদ্দীন আহমদ তাদের মধ্যেও ব্যতিক্রম। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দলীয় পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সরকার গঠনে তাজউদ্দীন আহমদ যে অচিন্তনীয় নেতৃত্ব-ব্যক্তিত্ব দেখিয়েছেন তা চিরস্মরণীয়।
সত্তুরের দশকে ভারতের কাছে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আওয়ামী লীগের আর কোনো বড় নেতার গ্রহণযোগ্যতা ছিলো বলে জানা যায় না। ঠিক ওই সময়ে অকল্পনীয় গতিতে চেপে বসা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে জাতীয় নেতৃত্ব নিয়ে ছাত্র-যুবনেতাদের আগ্রাসী প্রতিযোগিতা ছিল। কিন্তু সঠিক পদক্ষেপটি তাজউদ্দীন আহমদই নিয়েছিলেন। দলের সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে সরকার গঠন করে দেশের মাটিতে শপথ নিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বৈশ্বিক স্নায়ুযুদ্ধের সময়টাতে বিশ্বনেতাদের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রেখে চলছিলেন। তাঁর মতো দূরদর্শী নেতৃত্বের সামনে তাজউদ্দীন নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার তিনিই উপযুক্ত নেতা। প্রথম দিকে ইন্দিরা প্রশাসন তাজউদ্দীনের নেতৃত্বের প্রতি সংশয়হীন ছিল না। যে কারণে ছাত্র-যুবনেতাদের পৃথক একটি ধারাও তৈরি করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ যতই পরিণতির দিকে এগিয়েছে, ক্রমশ ভারত সরকার বুঝতে পারে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বই বাংলাদেশের মূলধারা। শেষ দিকে ভারত সরকার ছাত্র-যুবনেতাদের ধারাটিকে নিষ্ক্রিয় করে, পূর্ণ আস্থা রেখেছিল তাজউদ্দীন আহমদের সরকারের উপর।
অপ্রস্তুত সময়ে, অন্য একটি দেশের মাটিতে থেকে, তাদের সহায়তায় সশস্ত্র যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্ব করা পৃথিবীর কঠিণতম কাজের একটি। তাজউদ্দীন আহমদ অচিন্তনীয় ধৈর্য্য, মেধা, দক্ষতায় ও দূরদর্শিতার কারণে তা করতে পেরেছিলেন। কারণ তাঁর প্রস্তুতি ছিল, তাউজদ্দীন আহমদের তরুণ বয়সের ডায়েরী পড়লে তার সেই প্রস্তুতির ছাপ পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালি সামরিক অফিসাররা যখন প্রথাগত যুদ্ধের নকশা আকঁতে চেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিরক্ষামন্ত্রির দায়িত্বে থাকা তাজউদ্দীন আহমদ তখন গেরিলা যুদ্ধের ভিত্তিতে এগুনোর নির্দেশনা দেন। ভারতের শীর্ষ সমরবিদরাও তাজউদ্দীন আহমদের পরিকল্পনায় সমর্থন জানায়।
যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে শুধু যুদ্ধের ময়দানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভেতরে-বাইরে তাঁকে বহুমুখী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। নিজ দলের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল কোন পর্যায়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার উদ্দেশে গুপ্তঘাতক পাঠানোর ঘটনায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভারত তাঁর জায়াগা থেকে কূটনৈতিক যুদ্ধ করেছে। সমানতালে তাজউদ্দীন আহমদও তাঁর সরকারের পক্ষে থেকে সফল ক‚টনৈতিক চেইন গড়ে তুলেছিলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিবেশি দেশগুলোতে আলাদাভাবে কূটনীতিক পাঠানো ছিলো তাজউদ্দীনের পরিপক্ষ রাষ্ট্রনেতার দূরদৃষ্টি। শুধু তাই নয়, তিনি ভারতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য ও সে দেশের রাজধানীতে আলাদা মিশন পাঠান। যেন ভারতের সকল রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক যে দৃষ্টি আছে সেটা আরো বাড়ানো যায়। আর বৃটেন, আমেরিকা (সরকার বাদে) ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারি নিয়োজিত কূটনৈতিক মিশন ছিল খুবই সফল।
তাজউদ্দীন আহমদ একজন স্টেটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তথাকথিত রাজনীতিকদের মতো ছিলেন না। যা মুখে বলতেন, অন্তরে তা লালন করতেন। ভারতে সরকার গঠনের সময় সিদ্ধান্ত হলো, যুদ্ধ চলাকালে মন্ত্রিসভার কেউ পারিবারিক জীবন-যাপন করবেন না। অনেকে সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রীর অফিস সংলগ্ন একটি রুমেই পুরো যুদ্ধের সময়টা থেকেছেন, এখান থেকেই রণাঙ্গন পরিদর্শণে গেছেন, নিজের হাতে কাপড় নিজেই কেচে দিতেন। অফিস সহকারির জ্বর হলে প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছেন। তিনি কথা রেখেছেন, যুদ্ধ শেষে পারিবারিক জীবন শুরু করেছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর কাজের ফল নিয়ে কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তা বুঝা ভারতে সরকার পরিচালনার সময়ই। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর সরকারের কাজ শুধু যুদ্ধসংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন, কিভাবে বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে তার ছবি আকঁতে। বিভিন্ন দপ্তর গড়ে তুলে বলেছেন, স্বাধীন হওয়ার পর দেশে কিভাবে কাজ করতে হবে তার পরিকল্পনা করতে। ভারতে যাওয়া সব সরকারি কর্মচারিদের কাজে লাগিয়েছেন ভবিষ্যত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার পরিকল্পনার কাজে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকটায় ভারত নিজেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে সংশয়ে ছিলো। এতগুলো ভাষাভিত্তিক জাতির দেশ ভারতের কোলে যদি বাংলাদেশের মতো ভাষাভিত্তিক জাতির রাষ্ট্রের জন্ম হয় তাহলে ভারতের বিভিন্ন জাতির প্রদেশগুলোতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে, সেই চিন্তাও ভারতকে করতে হয়েছে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের সঠিক নেতৃত্ব, তরুণ রক্তের টগবগানো মুক্তিযোদ্ধারা সব হিসাব-নিকাশকে পাল্টে দিয়ে পৃথিবীর বুকে নতুন মানচিত্র এঁকেছে। যা এখনো পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর বিশ্বে নতুন এক বিস্ময়।
যুদ্ধকালের প্রধানমন্ত্রী কেমন ছিলেন তার একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। ছোট্ট সোহেল তাজের প্রচণ্ড জ্বর। বাসা থেকে জোহরা তাজউদ্দীন বার বার খবর দিচ্ছেন। তাজউদ্দীন বাসায় যাচ্ছেন না। অফিসে এক ভারতীয় বিষয়টা খেয়াল করে তাজউদ্দীন আহমদকে বললেন, স্যার কাজ শেষ করে সন্তানের জন্য বাসায় যেতেই পারতেন, হাতে সময়ও ছিল। তাজউদ্দীন উত্তর দিয়েছিলেন, আমার পরিবার সুরক্ষিত ফ্ল্যাট বাসায় থাকে। আমি না গেলেও অনেক সাহায্যকারী তারা পাবে। দেশে যুদ্ধের মধ্যে থাকা কত পরিবার যে অরক্ষিত ঘরহীন অবস্থায় আছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তো আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর