নিজস্ব প্রতিবেদক: উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্যসব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এমন ঘোষণা মানতে রাজি নয় কোনো পক্ষই। এ ছাড়া বিসিএস শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারভুক্ত না রেখে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো আলাদা করার প্রস্তাবের বিষয়েও আপত্তি এসেছে।
ইতোমধ্যে বিবৃতি, বৈঠক এবং অবস্থান কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এ ইস্যুতে চাপে পড়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে এ কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে।
উপসচিব পদে পদোন্নতিতে নতুন প্রস্তাব করার ঘোষণা:
উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সব ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছিল এতদিন। তবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এ পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্যসব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করতে চায়। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী এ তথ্য জানান।
আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা ছাড়া সিভিল সার্ভিসের উপসচিব এবং যুগ্ম-সচিব পর্যায়ে কেউ পদোন্নতি পাবেন না বলে সুপারিশ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাদের নেওয়ার সুপারিশ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বিসিএস শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারভুক্ত না রেখে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো আলাদা করার প্রস্তাব দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের তীব্র আপত্তি:
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের বক্তব্যের একদিন পর তীব্র আপত্তি জানান প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ১৯ ডিসেম্বর প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ) থেকে এক বিবৃতির মাধ্যমে এ সুপারিশ করার বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়। অ্যাসোসিয়েশন মনে করে, উপসচিব-সচিব পদে শতভাগই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন হওয়া উচিৎ। বিবৃতিতে বলা হয়, উপসচিব পদোন্নতি প্রত্যাশী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতামত, জরিপ, সমীক্ষা সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি বলে জানা যায়। ফলে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে মাঠ প্রশাসনসহ সকল স্তরে কর্মরত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কমিশন প্রধানের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ঢাকায় সমাবেশসহ ৫ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। কোটামুক্ত মেধাভিত্তিক উপসচিব পুল চায় এ পরিষদ। এতে আরও বলা হয়, আমরা অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে রাষ্ট্রের কল্যাণের স্বার্থে মনে করি যে, উপসচিব/যুগ্মসচিব/অতিরিক্ত সচিব/সচিব পদে শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন হওয়া উচিৎ।
প্রতিবাদ জানান ডিসিরাও:
প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্যসব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ ইস্যুতে গত ১৯ ডিসেম্বর সভা করেন দেশের সব জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। সভার কার্যবিবরণী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন তারা। কার্যবিবরণীতে বলা হয়, উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন যে ধরনের সুপারিশ করার চিন্তা করছে, তা বাস্তবতাবিবর্জিত। এ ধরনের উদ্যোগ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
৫ কর্মসূচি ঘোষণা আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের:
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ঢাকায় সমাবেশসহ ৫ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। কোটামুক্ত মেধাভিত্তিক উপসচিব পুল চায় এ পরিষদ।
শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পূর্ত ভবনে এই পরিষদের সাথে অন্তর্ভূক্ত ২৫টি ক্যাডারের নেতৃবৃন্দের একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় ৫ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে ২৫টি ক্যাডার সংগঠনের সভাপতি-সেক্রেটারিসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বৈষম্যমূলকভাবে উপসিচব পুলে একটি ক্যাডারের জন্য ৫০% কোটা সুপারিশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করায় সিভিল সার্ভিসের অন্য ২৫টি ক্যাডারের সকল সদস্যের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কমিশনের এ সকল সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে একটি গ্রুপ ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যমূলক তথ্য প্রচার শুরু করেছে।
তারা বলেন, উপসচিব পুলের পদগুলো কোনো নির্দিষ্ট ক্যাডারের নয়। সার্ভিস অ্যাক্ট ১৯৭৫ অনুযায়ী মেধার ভিত্তিতে এ সকল পদে নিয়োগের কথা থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে কোটা পদ্ধতি চালু রেখেছে প্রশাসন ক্যাডার। এ ছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এই অ্যাক্ট রহিত করে ২০২৪-এর নির্বাচনের পর এ সকল পদ নিজেদের তফসিলে অন্তর্ভূক্ত করেছে প্রশাসন ক্যাডার, যা মেধাভিত্তিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রগঠনে মারাত্মক অন্তরায়।
সচিবালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রতিবাদ:
উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমাতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এ ক্যাডারের কর্মকর্তারা রোববার দল বেঁধে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান নেন। দুপুরে কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধি দল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব ড. মোখলেস উর রহমানের কাছে তাদের দাবি পেশ করেন।
খসড়া সুপারিশ প্রত্যাখান শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের:
বিসিএস শিক্ষাকে ক্যাডারভুক্ত না রেখে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো আলাদা করার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে প্রতিবাদলিপি দিয়েছেন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন। প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, এই সুপারিশ সর্বতভাবে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। ২০১২ সালে অনুরূপ একটি প্রচেষ্টা আমরা প্রতিহত করেছি। বিষয়টি মীমাংসিত। সংস্কারের মাধ্যমে সব বৈষম্য নিরসন ও গতিশীল জনবান্ধব জনপ্রশাসন তৈরির লক্ষ্যে গঠিত কমিশনের এ ধরনের সুপারিশ বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের বৈষম্যবিরোধী মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই এ সুপারিশ প্রত্যাহার করা না হলে কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার ব্যর্থ হবে।
আপত্তি স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তাদেরও:
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ইস্যুতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনও। বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন এক প্রতিবাদলিপিতে জানায়, বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৩৫ হাজার সদস্যের মুখপাত্র বিসিএস হেলথ ক্যাডার এসোসিয়েশন এ ধরনের একতরফা সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে।
এতে আরও বলা হয়, আমরা সংস্কার কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই, তবে দুরভিসন্ধিমূলক সুপারিশকে সংস্কার প্রস্তাব হিসেবে মানা হবে না। হেলথ ক্যাডারের সঙ্গে আলোচনা ব্যতীত কোনো সংস্কার প্রস্তাব মেনে নেওয়া হবে না।
আলোচনার পর ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকবে না:
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো মোখলেস উর রহমান বলেন, কয়েকটি মৌলিক বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। চলতি সপ্তাহেই বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সঙ্গে বসবে কমিশন। এরপর কারও মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকবে না। অন্যান্য ক্যাডারের সাথে আগেই বৈঠক হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।