মোশাররফ হোসেন: ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ সাবেক ছাত্র ছাত্রীদের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৩ মে। চট্টগ্রাম কলেজ চত্বরে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র ছাত্রী পরিষদ ছিল এ মিলনমেলার আয়োজক।
১৯৭২-৭৪ এ কলেজের ছাত্র ছিলাম। পড়া লেখার পাশাপাশি সংস্কৃতি, খেলা, ইউওটিসি,রাজনীতি সবকিছুর সংগে সময় কেটেছে দূর্বার গতিতে।যা আজও সরণীয়। কলেজিয়েট স্কুলের বন্ধুরা মিলে দেশপ্রেমিক ভূমিকা, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে আমরা এগিয়ে নিতে কাজ করেছিলাম।
মহান একুশের প্রভাত ফেরিতে গরুর গাড়িতে চড়ে গান পরিবেশন করা ছাড়াও অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এর উৎসাহ পেয়ে বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা ও দেয়ালিকা, কবিতা সংকলন বের করে এক ঝাঁক পায়রা। বন্ধু চন্দ্রশেখর সাহা র প্রচ্ছদে কবিতা লিখেছিল সাদেকুর রহমান , অনুপ সাহা, চন্দ্রশেখর সাহা, সাইফুদদিন এম তারেক, মোশাররফ হোসেন, মোঃ ইউসুফ, শহীদ সরওয়ার, উদয়ন বিশ্বাস, অনুপ চৌধূরী, সুপ্রিয় রক্ষিত সহ অন্যান্যরা।
মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এর নাটক এসপারটাকাস বিষয়ক জটিলতা তে সেসময় অভিনয় করেছেন সদরুল পাশা, খসরুল কবির সহ অন্যান্যরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল বছর জুড়ে। কলেজ ছাত্র সংসদ বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। খেলা হত চট্টগ্রাম কলেজ মাঠে।ক্রিকেট দলে ছিলেন আমার বন্ধু সাদেক, আমানুল হক, হাবিব। হকি খেলেছি লিয়াকত সারের আবদুল মান্নান সারের পরিচর্যায়।
আবার ইউওটিসিতে ছিলেন আবুল হাশেম,সেকান্দার , মোহাম্মদ শাহ, বারি,মনোয়ার, পুলক, অনিল , মোসাদদেক, ইন্দ্রনীল বড়ুয়া, ও আমি সহ অনেকে। বান্ধবীদের মধ্যে ছিল, মুনিরা, রিজিয়া,মিলি, মাহমুদা, কিশোয়ার, আফরিন, ফাতেমাসহ অনেকে। অনেকের নাম মনে নেই। তবে ছাত্র সংসদ এর সহ সভাপতি বোরহান উদ্দিন আহমেদ ভাইয়ের সংগে টরনটোয দেখা হয়।এখানে চট্টগ্রাম কলেজ এলামনাই এসোসিয়েশন আছে। আমরা সবাই আছি এর সংগে।
কলেজ জীবনের শিক্ষককে কাছে পেয়ে শ্রদ্ধায় নত হয়েছেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। আর সতীর্থদের জড়িয়েছেন আলিঙ্গনে। আড্ডায়, গানে ও স্মৃতিচারণায় ফিরে গেছেন যেন ফেলে আসা সোনালী দিনে। এভাবেই উৎসবের রঙে মাতোয়ারা একটি দিন কাটিয়েছেন ঐতিহ্যাবহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা।
চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পুনর্মিলন-২০২২ এর আয়োজন করা হয় নগরীর নেভি কনভেনশন সেন্টারে। সেখানেই কলেজের আবহ আনতে প্রশাসনিক ভবন, রেড বিল্ডিংসহ বিভিন্ন ভবনের বিশাল আকারের ছবি স্থাপন করা হয়। সেসব ছবির সামনে সাবেক শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে ছবি তুলেছেন। আড্ডায় মেতেছেন।
সকাল ৯টায় পুনর্মিলনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন কলেজের সবচেয়ে বর্ষীয়ান সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক চিত্ত প্রসাদ তালুকদার (৯৮)।
এসময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী আহমদ কায়কাউস। জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এসময় সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়।
এরপর পুনর্মিলনী আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী আলী আহমদ ও সদস্য সচিব এস এম আবু তৈয়ব বক্তব্য রাখেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সমন্বয়ক একরামুল করিম। এরপর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা দেন চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আবুল হাসান।
তারপর শুরু হয় স্মৃতিচারণ পর্ব। স্মৃতিচারণায় অংশ নিয়ে নিজেদের সোনালী অতীত, কলেজ ক্যাম্পাসে ফেলে আসা দিন, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও সহপাঠীদের নানা বিষয় তুলে ধরেন কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইসমাইল খান, সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিল্পগোষ্ঠী একে খান গ্রুপের সালাউদ্দিন কাশেম খান, সাবেক মুখ্য সচিব ড. আবদুল করিম, সাবেক সচিব মো. নাসির উদ্দিন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহফুজা আখতার, দৈনিক পূর্বকোণ লিমিটেডের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন চৌধুরী, লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়াসহ অনেকে।
স্মৃতিচারণায় একে খান ফাউন্ডেশনের নামে চট্টগ্রাম কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালুর ঘোষণা দেন সালাউদ্দিন কাশেম খান।
স্মৃতিচারণায় অধ্যাপক চিত্ত প্রসাদ তালুকদার বলেন, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম কলেজে পড়েছি। আমাদের সময়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের ভালোবাসা পেয়েছি। আমার বন্ধুদের কাউকে আজ আর দেখি না। ছাত্রদের অনেককেই আজ দেখলাম। খুব ভালো লাগছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু সিকান্দার খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মোহিত উল আলম, বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক হাসিনা জাকারিয়া বেলা, অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম, আইনজীবী আবুল হাশেম, ডা. শেখ শফিউল আজম প্রমুখ।
স্মৃতিচারণা শেষে মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর প্রায় ২২০০ প্রাক্তনী আবার মাতেন স্মৃতিমূলক অনুষ্ঠান, কৌতুক পরিবেশন, কুইজ প্রতিযোগিতা, কবিতা পাঠ ও গল্প বলা, কলেজ বন্ধুদের পরিবেশনায় গানের অনুষ্ঠানে।
সন্ধ্যায় অতিথি শিল্পীদের সাথে গানে গলা মিলিয়ে সবাই যেন ফিরে যেতে চান ফেলে আসা দিনে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ এসেছেন বিদেশ থেকেও। সঙ্গে ছিল ছেলেমেয়েরা। নিজেদের সোনালী অতীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন সন্তানদের।
র্যাফেল ড্রতে দিনের আয়োজন শেষ হলেও এই শেষ যেন আরেক শুরুর বার্তা দিয়ে যায়। দিনভর আড্ডায় অনেক হারানো বন্ধুর খোঁজ মিলেছে। মনের কথা বলেছেন প্রিয় বন্ধুকে। নিয়েছেন ফোন নম্বর। আর ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও যুক্ত হয়েছেন পরস্পর। অনেকে নতুন এই সংযোগে যুক্ত হতে খুলেছেন ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ। একদিনের মিলনমেলা শেষ হলেও এই যোগাযোগ রয়ে যাবে সারাজীবন। এবারের পুনর্মিলনী তাই শুধু এক দিনের গন্ডিতে আবদ্ধ নয়। এ যেন নতুন যাত্রার সূচনার শুভক্ষণ।