নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ ৫৪তম মহান বিজয় দিবস। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে স্থান পায় একটি ভূখণ্ড। ৩০ লাখ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে বাংলার ভূমি। এতে অর্জিত হয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, পায় স্বাধীনতা। বাঙালি জাতি পায় লাল-সবুজের পতাকা। শত শত সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ ও হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়ে বিজয় নিশান ওঠে বাঙলার বুকে।
পাকিস্তানের নৃশংস হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে যখন এ দেশের ঘুমন্ত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাংক-কামানের মতো ভয়ংকর মারণাস্ত্র নিয়ে গণহত্যার পৈশাচিকতায় মেতে উঠেছিল, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রাম।
দেশের বীর সন্তানেরা যুদ্ধের ময়দানে ছুটে গিয়েছিলেন শত্রুর মোকাবিলায়। জীবনের মায়া তাঁদের কাছে ছিল তুচ্ছ। তাঁদের ছিল না যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, ছিল না কোনো উন্নত সমরাস্ত্র। যাঁর কাছে যা ছিল, তা–ই নিয়েই দেশের বীর সন্তানেরা শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মরণপণ লড়েছিলেন মুক্তির সংগ্রামে।
দীর্ঘ ৯ মাস হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো এক শক্তিমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ করেছিলেন দেশের সব ধর্ম, বর্ণ, ভাষার বীর সন্তানেরা। ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর বিপুল সম্পদহানির ভেতর দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে সফল হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ছিনিয়ে এনেছিলেন চূড়ান্ত বিজয়। জাতিকে মুক্ত করেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে।
এই ডিসেম্বরের কুয়াশাঢাকা বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য, উড্ডীন হয়েছিল লাল-সবুজ পতাকা। বাতাসে অনুরণন তুলেছিল অগণিত কণ্ঠের সুর ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি…।’ আজকের দিনটি তাই একদিকে যেমন এ দেশের মানুষের কাছে চিরকালের, চিরগৌরব ও আনন্দের; তেমনি একই সঙ্গে স্বজন হারানোর বেদনাতেও নীল।
জাতি আজ এই বিজয়ের আনন্দের দিনে গভীর কৃতজ্ঞতা ও পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর সন্তানদের। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ভরে যাবে অগণিত মানুষের নিবেদিত শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে।
সরকারি কর্মসূচি:
বাসস জানায়, মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। শনিবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয় জানায়, ১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সময় ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটি শুরু হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনৈতিকরা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর সরকারি ছুটির দিন। সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও স্থাপনাগুলো জাতীয় পতাকা ও রঙিন নিশানে সাজানো হবে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা বাণী দেবেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করবে।
এছাড়াও দেশের সব জেলা ও উপজেলায় দিনব্যাপী আড়ম্বরপূর্ণ বিজয়মেলার (চারু, কারু ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিল্প পণ্যের) আয়োজন করা হয়েছে। শিশুদের জন্য থাকবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ কর্মসূচি নেওয়া হবে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আরও জানায়, এদিন বিকালে বঙ্গভবনে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারগুলোকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এ উপলক্ষে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারি শিশুসদনসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাট, পগলা ( নারায়ণগঞ্জ) ও বরিশালসহ বিআইডব্লিউটিসির ঘাটে এবং চাঁদপুর ও মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো দুপুর ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। দেশের সব শিশু পার্ক ও জাদুঘর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে এবং সিনেমা হলে বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে।
এ ছাড়া মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীসহ সারা দেশেই বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে।
শ্রদ্ধা–ভালোবাসায় সিক্ত হতে প্রস্তুত জাতীয় স্মৃতিসৌধ:
এদিকে বিজয় দিবস উপলক্ষে স্মৃতিসৌধকে সাজানো হয়েছে নানা সাজে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা। দিবসটি উপলক্ষে গণপূর্ত বিভাগের কর্মীদের টানা কয়েকদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে এক নতুন রূপ ধারণ করেছে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। শেষ করা হয়েছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও শোভাবর্ধনের কাজ।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদফতরের উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এবারও স্মৃতিসৌধকে সাজানো হয়েছে নতুন আঙ্গিকে । শেষ করা হয়েছে ধোয়ামোছা, সাফসুতর ও রঙতুলির কাজ। স্মৃতিসৌধের মূল ফটক থেকে স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত ইটের গাঁথুনিগুলোতে দেওয়া হয়েছে লাল-সাদা রঙের আঁচড়। পায়েহাঁটার পথগুলোর দুই পাশে বসানো হয়েছে লাল টকটকে ফুল গাছের টব। লাল-সবুজের আভায় সেজেছে পুরো স্মৃতিসৌধ এলাকা।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ফুল দেবেন, এর পরপরই উপদেষ্টা, কূটনীতিক, বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার স্মৃতিস্তম্ভে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে সৌধ এলাকা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।’