মোশাররফ হোসেন : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়দিবস আনন্দ ও বেদনার দিন । মহান মুজিব জন্মশতবার্ষিকীতে ১০ ডিসেম্বর ,২০২০ বাঙালির ইতিহাসে ‘পদ্মাবিজয়’ ঠিক তেমনি আনন্দ বেদনার দিন। এ যেন মেঘের কোলে রোদ হেসেছে ,, বাদল গেছে টুটি ,, আ হা হা ,, । আজি কী আনন্দ আকাশে ,, বাতাসে,, ।পাখি ডাকে,,।বদলে যাবে জীবন । প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ১২ শতাংশ ।স্বপ্ন এখন বাস্তব ।
বিশ্ব ব্যাংকের গভীর ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পদ্মা সেতুর সংযোগ স্থাপন করেছে । এখন সেতুর ৬.১৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান । ১০ ডিসেম্বর ২০২০ সেতুর ৪১তম স্পান’স্থাপনের দিনে তাইতো ১৭ কোটি মানুষের জন্য আনন্দের দিন । এদিন পদ্মার দু’পারে জনতার ঢল নেমেছিল । সন্ধ্যায় স্বত;স্ফুর্ত আতশবাজির খেলা দেখা গেছে । আবার ব্শ্বি নেত্রীও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আনন্দ ও বেদনার । কেননা পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণ কাজের অর্থছাড়ের আগে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থ সহায়তা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল । তাদের অনুসরণ করে আইডিবি ও জাইকা ।
এমনকি বিশ্বব্যাংক একের পর এক শর্ত জুড়ে সরকারের তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন , সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভুইয়াসহ সরকারি কর্মকতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে ।এমন পরিস্তিতিতে যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন সরে দাঁড়ান ।সেতু সচিব সরে দাঁড়ানোর পরও প্রধানমনত্রী শেখ হাসিনার অর্থ উপদেষ্টা ড: মসিউর রহমানকে সরানোর জন্য চাপ দেয় । কিন্তু সরকার তাতে রাজি হয়নি । সেতু সচিবকে কিছুদিন জেলে কাটাতে হয় ।
এরকম অবস্থায় সরকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিতকে বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে প্রেরণ করে। আলোচনা ফলপ্রসু না হওয়ায় বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রতিনিধি পদ্মা সেতুতে অর্থ প্রদানে অপারগতার কথা ঘোষনা করেন ।২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক মরিনো ও গাম্পের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত দল বাংলাদেশে প্রেরণ করে । শুধু তাই নয় বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টতার জন্য কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এন সি লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডার আদালতে মামলা দায়ের করে । আদালত ঘটনা সংশিষ্ট কাগজপত্র জমা দেয়ার জন্য বিশ্ব ব্যাংককে নির্দেশ দেয় । কিন্তু বিশ্ব ব্যাংক গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলে নথিপত্র আদালতে জমা দিতে অস্বীকৃতি জানায় । এরকম অবস্থায় কানাডার আদালত মামলার রায়ে এন সি লাভালিনসহ সকলকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয় । দুর্নীতির অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মামলা নাকচ করে দেয় ।
এর সূত্র ধরে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে , শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে হেয় করার অপচেষ্টা করেছিল বিশ্ব ব্যাংক । এর নেপথ্যে ছিলেন দেশী ও বিদেশী চক্র । দেশের নোবেল লরিয়েট ও দুই শীর্ষ কাগজ । ধীরে ধীরে সত্য বেরিয়ে আসবে। ১৯৬২ সালে মিশরের নীল নদের উপর সেতু করার সময় বিশ্বব্যাংক একইভাবে সরে দাঁড়িয়েছিল । অথচ পদ্মা নদিতে জাহাযে বসে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিতের উপস্থিতিতে মিডিয়ার সামনে সেতু কর্তিপখের সাথে পদ্মা সেতু নির্মানের জন্য অর্থ সহয়তা করার চুক্তি করেছিল বিশ্ব ব্যাংক কিন্তু মিথ্যা অযুহাতে সেই চুক্তি ভংগ করে ।
পদ্মা সেতু ২১ জেলার জীবন বদলে দেবে বিশজুড়ে পদ্মা সেতু নিয়ে এখন চলছে তোলপাড় । কারিগরি রেকর্ড ও আগামীতে অর্থনৈতিক বিপ্লবের হিসেব নিকেশ শুরু হয়েছে । বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমানচলের ২১ জেলার মানুষের জীবন বদলে যাবে । খুলে যাবে ট্রান্স এশিয়ার সংযোগ । পায়রা সমুদ্র বন্দর ও পদ্মার পাড়ে গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা , আন্তর্জাতিক নতুন বিমানবন্দর ,পরিকল্পিত আবাসন । আগামী ২০২২ সালের জুনে সেতুর উপর দিয়ে রেল ও সড়ক চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে । তবে এর আগে পদ্মা সেতু নির্মান মহায়জ্ঞ বিষয় জানা দরকার।
১৯৯৮ -৯৯ সালে জাইকা পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা প্রাক সমীক্ষা জরিপ শেষ করার পর ২০০৯ থেকে ২০১১সালে সেতুর নকশা বিষয়ক কাজ করে বিশ্ব বিখ্যাত সেতু প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইনজিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন (এইসিওএম) যুক্তরাজ্যের নর্থওয়েস্ট হাইড্রো কনস্ট্রাকশন (এসএমইএল) এসিই কনস্ট্রাকশন । ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সেতু কতৃপক্ষের সংগে চুক্তির পর উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান জমি অধিগ্রহন , সেতু , নদীশাসন , জাজিরা ও মাওয়া সংযোগ সড়ক ,সার্ভিস ,পরিবেশ ,কারিগরি সহায়তা বিষয়ক কাজের পরামর্শ দেয় । ফ্লিন্ট ও নেইল এসব রিভিউ করে । এসময় বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরি ছিলেন সেতুর প্রধান পরামর্শক ।তাকে সহায়তা করতেন একটি দেশীয় বিশেষজ্ঞ প্যানেল। আর বিশ্বব্যাংক সব সাহায্যের সঙ্গে তাদের নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক নেয়ার শর্ত দিয়ে থাকে । ২০১৪সালে প্রকল্প অনুমোদনের পর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ।
কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়নের জন্য সেতুর কাজ শুরুতে দু’বছর বিলম্ব হয় । তবে তার আগে আন্তর্জাতিক দরপত্র শেষে চীনের চায়না মেজর ব্রীজ ইনজিনিয়রিং লিমিটেডকে মুল সেতুর ৬.১৫ কিলোমিটার কাজে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ,সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেডকে নদীশাসনে ১৪কিলোমিটার কাজে ৯ হাজার ৪০ কোটি,জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়ক কাজে দক্ষিন কোরিয়ার এএলএম এইচসিএন জেভি কে ১ হাজার ৯৭ কোটি , মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সড়ক কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইএসএসটিকে ১৯৩ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয় ।মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে গতবছর । জাজিরা প্রান্তে সড়ককের ৮৪ ভাগ শেষ হয়েছে । গত ১০ ডিসেম্বর ২০২০, মূল সেতুর ইস্পাতের তৈরি ৪১তম স্প্যাণ বসানোর মাধ্যমে চায়না ইনজিনিয়ারিং পদ্মা সেতুর জাজিরা ও মাওয়ার সংযোগ কাজ শেষ করেছে ।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যাণ বসানো হয়েছিল । বাকী রয়েছে দ্বিতল সেতুর নীচতলার রেলওয়ে ১০২৯ স্ল্যাব, উপরতলার সড়কে ১৬৩২টি স্ল্যাব, ব্রীজের রেলিং,বর্নাঢ্য আলোকসজ্যা ,গ্যাস ,বিদ্যুতলাইনের সংযোগ ।এসব শেষ করতে ২০২২সালের জুন গড়াবে । এদিকে করোনার জন্য মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করেছে সরকার । এতে করে পদ্মা ব্রীজের কাজ ঐ সময়ের আগেও শেষ করা হতে পারে বলে জানা গেছে ।
জমি বাজেট কারিগরি যথার্থতাঃ শরীয়তপুর , মুনশিগনজ ও মাদারিপুর জেলার প্রায় ১১০০ হেক্টর জমি অধিগ্রহন করা হয় ২০০৬ সালে শুরুর পর ক্ষতিপুরণ দিয়ে একাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর । তবে শরীয়তপুর ও মাদারিপুরে অনেক জায়গা ফেরত দেয়া হয় । ১০হাজার ১৬ কোটি থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাজেট দাঁড়িয়েছে ৩০হাজার ১৯৩ কোটি টাকা । সমুদয় অর্থ বাংলাদেশের নিজস্ব । বিশ্ব ব্যাংক , ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক জাইকাসহ দাতা গোষ্ঠি সেতু নির্মাণ কাজ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর বাংলাদেশ ব্যাংক ,জনতা ,সোনালিসহ দেশের ব্যাংকিং খাত সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল । বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিদেশী রিজার্ভের সুদ থেকে লাভের টাকা দিয়ে সেসময় সহায়তা করেছিল ।
এজন্য গভর্ণর ও বিশিষ্ট অর্থনিিতবিদ ড; আতিউর রহমান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ।অর্থনীতিবিদ ও জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত রেখেছিলেন অনন্য ভুমিকা । অবশ্য সবকিছুর মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রধানমনত্রী শেখ হাসিনা । সড়ক ও সেতু বিষয়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেতু বিভাগের সচিব ও বর্তমান মন্ত্রীপরিষদ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুনির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রীসভায় উপাস্থাপন করেছিলেন ।
পদ্মা নদীর প্রকৃতি ও স্রোতধারা এতো তীব্র যে, বর্ষাকালে নদীর তলদেশ থেকে ৬৫ মিটার বালি সরে যায় । ধূয়ে যায় সর্ব্বোচ্চ ২১৩ ফুট মাটি । যা ২১ তলা বিল্ডিংয়ের সমান । বালি , নরম ও কাদামাটির মিশ্রণে গঠিত এর মাটির স্তর । এলাকা ভেদে ভিন্নতা রয়েছে । তাই ১২২ মিটার পাইলিং করে বসানো হয়েছে প্রতিটি খুটি । একাজে জার্মাানীর তৈরি ইস্পাতের পাইল ব্যবহার করে কংক্রিটের ঢালাই দেয়া হয়েছে । আবার ৬টি ইস্পাতের কলাম সর্বনিম্নে খুটির ভারসাম্য রক্ষা ও ৯ মাত্রার ভূকম্পন নিরোধকে এটি কাজ করবে । পাশাপাশি সামলে নেবে জলোচ্ছাস ও ঝড় । এসব খুটি বসাতে জার্মানীর ১০ টন ওজনের হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে । সেতু খুলে দেয়ার সূচনাদিনে ১২ হাজার যান চলবে।২০৩০ সালে তা দাড়াবে দিনে ৩০ হাজার । টোল আদায় হবে ২.৫০কোটি টাকা এ হিসেব সেতু কতৃপক্ষের । এছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীর ৯৯ ব্রিগেড দায়িত্ব পালন করছে। আগামীতে জাজিরায সেনানিবাস তৈরি করা হবে ।
সর্বোপরি উন্নয়নশীল দেশের দিকে ধাবমান বাংলাদেশ। এখন অর্থনৈতিক জোট ‘ব্রিকস ’ এর সঙ্গে যুক্ত । বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিপক্ষ । এতে আছে ব্রাজিল ,রাশিয়া ভারত ,চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশ । আমেরিকা ও ইউরোপের সহায়তায় পরিচালিত বিশ্ব ব্যাংক আগেরমত অর্থনৈতিক চাপে ফেলার সুয়োগ কমে গেছে।