# স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য সুপারিশ
# মন্ত্রণালয়-বিভাগ কমিয়ে ২৫ ও ৪০টি করার প্রস্তাব
# উপসচিব পদে ৫০ অন্য কোটায় ৫০ করার সুপারিশ
# প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বিচারবিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুর ১টার দিকে এ দুই সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী প্রতিবেদনগুলো হস্তান্তর করেন।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন কী রয়েছে তা নিয়ে বিস্তারিত জানা না গেলেও জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে শতাধিক সুপারিশ থাকতে পারে বলে আগে জানা গিয়েছিল।
গত ৮ আগস্ট সরকার গঠন করার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে গত ১৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ এবং সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে রিপোর্ট জমা দেয়।
গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, আমাদের রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা ছিল গত মাসে। কিন্তু আমরা আমাদের কাজের কারণে পারিনি। কারণ আমরা মাঠে গিয়েছি, লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গিয়ে আমরা কথা বলেছি, অনলাইনে আমরা মতামত নিয়েছি। প্রতিবেদনে ১০০টির বেশি সুপারিশ থাকছে। এখন এর বাইরে আমি কিছু জানাতে পারব না।
গত ৩ অক্টোবর ৮ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। পরে কমিশনের সদস্য সংখ্যা আরও তিনজন বাড়ানো হয়। ৩ মাসের মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন হস্তান্তর করতে বলা হয়। এরপর তিন দফা বাড়িয়ে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় বেঁধে দেওয়া বর্ধিত সময়ের ১০ দিন আগেই প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হলো।
অন্যদিকে বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয় ৩ অক্টোবর।
স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য সুপারিশ
অতীতে বিভিন্ন সরকারের সময়ে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোট জালিয়াতি, অর্থপাচার, দুর্নীতি এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অতীতে বিভিন্ন সরকারের সময়ে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোট জালিয়াতি, অর্থপাচার, দুর্নীতি এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্টের গণহত্যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে জনপ্রশাসনের পেশাদারিত্ব, ভাবমূর্তি ও একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তের জন্য মাঠপর্যায়ে জনমত রয়েছে বিধায় একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে কমিশন মনে করে।
অন্যদিকে, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, ২০১৮-এর ৪৫ ধারা সংশোধন করে কোনো সরকারি কর্মচারীর ২৫ বছর চাকরিকাল পূর্তিতে তাকে সরকার থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার বিধান বাতিল করার জন্য সুপারিশ করা করেছে কমিশন।
বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারগুলোকে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় একীভূত ‘ক্যাডার’ সার্ভিস বাতিল করে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় একীভূত ‘ক্যাডার’ সার্ভিস বাতিল করে তার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের কাজের ধরন ও বিশেষায়িত দক্ষতার বিষয়টি সামনে রেখে আলাদা আলাদা নামকরণ করা যেতে পারে। বিদ্যমান বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারগুলোকে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হলো।
সুপারিশগুলো হলো: ১. বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস। ২. বাংলাদেশ বিচারিক সার্ভিস। ৩. বাংলাদেশ জননিরাপত্তা সার্ভিস। ৪. বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সার্ভিস। ৫. বাংলাদেশ হিসাব সার্ভিস। ৬. বাংলাদেশ নিরীক্ষা সার্ভিস। ৭. বাংলাদেশ রাজস্ব সার্ভিস। ৮. বাংলাদেশ প্রকৌশল সার্ভিস। ৯. বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস। ১০. বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস। ১১. বাংলাদেশ কৃষি সার্ভিস। ১২. বাংলাদেশ তথ্য সার্ভিস। ১৩. বাংলাদেশ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস।
উপসচিব পদে ৫০ অন্য কোটায় ৫০ করার সুপারিশ
উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় একীভূত ‘ক্যাডার’ সার্ভিস বাতিল করে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
কমিশন সূত্রে এসব আভাস পাওয়া গেছে।
কমিশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, বাস্তবতার নিরিখে প্রশাসনিক সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় বর্তমানে উপসচিব পদের মধ্যে ৭৫ ভাগ এ সার্ভিসের জন্য সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা রাখা আছে। সব সার্ভিসের মেয়াদি সমতা বজায় রাখার স্বার্থে এবং জনপ্রশাসনের উচ্চতর পদে মেধাবীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কমিশন প্রশাসনিক সার্ভিসের ৭৫ শতাংশ কোটা হ্রাস করে ৫০ শতাংশ করার বিষয়টি অধিকতর যৌক্তিক মনে করছে।
এতে বলা হয়, অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ পদ অন্যান্য সার্ভিসের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলার রায় ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টির আইনগত দিক পরীক্ষা করে দেখার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
মন্ত্রণালয়-বিভাগ কমিয়ে ২৫ ও ৪০টি করার প্রস্তাব
সরকারের কাঠোমোতে বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগ রয়েছে। এ সংখ্যা কমিয়ে মোট ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোকে যুক্তিসংগতভাবে হ্রাস করে মোট ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার সুপারিশ করেছে। এছাড়া মন্ত্রণালয়কে পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার প্রস্তাবও দিয়েছে কমিশন।
প্রস্তাবে বলা হয়, কমিশন সব মন্ত্রণালয়কে সমপ্রকৃতির পাঁচটি স্বল্প মেয়াদি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করছে। মন্ত্রণালয়/বিভাগকে পাঁচটি গুচ্ছে বিন্যস্ত করা যেতে পারে— (ক) বিধিবদ্ধ প্রশাসন; (খ) অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য, (গ) ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ; (ঘ) কৃষি ও পরিবেশ; (ঙ) মানব সম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন। মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলোর সাংগঠনিক ও মধ্য জনবল কাঠামো সংস্কারের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের উদ্যোগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মেয়াদি আলোচনা করে অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলোর সাংগঠনিক ও জনবল কাঠামো পর্যালোচনা করতে হবে। তারা তাদের সুপারিশ/প্রস্তাব স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটির কাছে পাঠাবে এবং কমিশন তা পর্যালোচনা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকার প্রধানের কাছে পেশ করবে।
মন্ত্রণালয়ে নীতি ও পরিকল্পনা ইউনিট শক্তিশালী করার বিষয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিদ্যমান বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগে মধ্য পরিকল্পনা কোষ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি যাতে মেয়াদি আরও কার্যকরভাবে সম্পাদন করা যায় সেজন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগে নীতি এবং পরিকল্পনা অধিশাখা/অনুবিভাগ গঠন করে দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ জনবল নিয়োগ করতে পারে।
রাজধানী মহানগর সরকার ‘নয়াদিল্লির মতো’ গঠনের সুপারিশ
ঢাকা মহানগরী, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে রাজধানী মহানগর সরকার (ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট) ‘ভারতের নয়াদিল্লির মতো’ গঠনের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কমিশন চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া কমিশন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করেছে। সুপারিশে মন্ত্রণালয় ২৫টি ও অধিদপ্তর ৪৪টি করার প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের নাম পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে কমিশন। সুপারিশে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার নামের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ
দেশের পুরাতন চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং সরকারের কার্যপরিধি সুবিস্তৃত হওয়ার ফলে বর্তমান মধ্য প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার কাঠামো যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয় না। অপরদিকে, মেয়াদি এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় মন্ত্রণালয় পর্যায়ে খুঁটিনাটি বহু কাজ সম্পাদন করা হয়। ক্ষমতার প্রত্যর্পণ (ডেলিগেশন) বিবেচনায় দেশে বিশাল জনসংখ্যার পরিষেবা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করার লক্ষ্যে দেশের পুরাতন চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এর ফলে এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা শহরের ওপর চাপ হ্রাস পাবে।
রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় রেখে দিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট বা রাজধানী মেয়াদি মহানগর সরকার (ঈধঢ়রঃধষ ঈরঃু এড়াবৎহসবহঃ) গঠনের সুপারিশ করা হলো। অন্যান্য প্রদেশের মতো এখানেও নির্বাচিত আইন সভা ও স্থানীয় সরকার থাকবে। ঢাকা মহানগরী, টঙ্গি, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্টের আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে।
জেলা পরিষদ বাতিল
স্থানীয় সরকারের একটি ধাপ হিসেবে জেলা পরিষদ বহাল থাকবে কি না, সে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা রয়েছে। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কখনোই নাগরিকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি। কিছু জেলা পরিষদ বাদে অধিকাংশেরই নিজস্ব রাজস্বের শক্তিশালী উৎস নেই। ফলে অধিকাংশ জেলা পরিষদ আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সেহেতু জেলা পরিষদ বাতিল করা যেতে পারে। জেলা পরিষদের সম্পদ প্রস্তাবিত সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারকে হস্তান্তর করা যেতে পারে।
পৌরসভা শক্তিশালীকরণ
পৌরসভার গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানীয় সরকার হিসেবে একে অধিকতর শক্তিশালী করার জন্য সুপারিশ করা হলো। পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন ওয়ার্ড মেম্বারদের ভোটে। কারণ, চেয়ারম্যান একবার নির্বাচিত হলে মেম্বারদের আর গুরুত্ব দেয় না।
উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা
স্থানীয় সরকার হিসেবে উপজেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সুপারিশ করা হলো। তবে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদটি বাতিল করা যেতে পারে। উপজেলা পরিষদকে আরও জনপ্রতিনিধিত্বশীল করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশকে আবর্তন পদ্ধতিতে পরিষদের সদস্য হওয়ার বিধান করা যেতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে উপজেলা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত না রেখে তাকে শুধু স্বল্পমেয়াদি সংরক্ষিত বিষয় ও বিধিবদ্ধ বিষয়াদি যেমন- আইনশৃঙ্খলা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ইত্যাদি দেখাশোনার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হলো। এর উদ্দেশ্য তাকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রাখা। একজন সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার অফিসারকে উপজেলা পরিষদের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
ভূমি ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় শ্রেণির একজন ভূমি মধ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কর্মরত মেয়াদি কানুনগোদের মধ্য থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অধীনে তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন করা যেতে পারে। এ রূপ পদোন্নতির পরীক্ষা পিএসসির মাধ্যমে হতে হবে। পরবর্তী সময়ে তারা পদোন্নতি পেয়ে ২৫ শতাংশের মতো সহকারী কমিশনার (ভূমি) হতে পারবে।
ইউনিয়ন পরিষদের সংস্কার
ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে ৯ থেকে ১১ করা যেতে পারে। প্রতিটি ওয়ার্ডে দুইজন সদস্য নির্বাচিত হবেন, যাদের মধ্যে মেয়াদি একজন অবশ্যই নারী হতে হবে বলে বিধান করার সুপারিশ করা হলো। এর ফলে একদিকে মহিলাদের ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব এবং তাদের কর্ম এলাকা সুনিশ্চিত হবে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন মেম্বারদের ভোটে। কারণ চেয়ারম্যান একবার নির্বাচিত হলে মেম্বারদের আর গুরুত্ব দেয় না।
এর আগে বুধবার দুপুর ১টার দিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বিচারবিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী প্রতিবেদনগুলো হস্তান্তর করেন।
কুমিল্লা-ফরিদপুর নতুন দুই বিভাগ
কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে মোট ৮টি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে। ভৌগোলিক ও যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনায় কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ গঠনের দাবি অনেক দিনের। সুতরাং কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করার সুপারিশ করা হলো। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবি পরিবর্তনেরও সুপারিশ করেছে কমিশন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবি পরিবর্তন করে যথাক্রমে উপজেলা কমিশনার (ঝঁন-উরংঃৎরপঃ ঈড়সসরংংরড়হবৎ, ঝউঈ) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার (উরংঃৎরপঃ গধমরংঃৎধঃব ্ উরংঃৎরপঃ ঈড়সসরংংরড়হবৎ, উঈ) করার জন্য সুপারিশ করা হলো।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পদবি পরিবর্তন করে অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা) করা যেতে পারে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়েও প্রস্তাব করেছে কমিশন।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর মামলা প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হলো। অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশী বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন তিনি। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাবে। এর ফলে সাধারণ নাগরিকেরা সহজে মামলা করার সুযোগ পাবেন।
এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন। সুপারিশে বলা হয়, উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি স্বল্পমেয়াদি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপন করা হলে সাধারণ নাগরিকেরা অনেক বেশি উপকৃত হবেন। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।