নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একটি বিশাল মহাকাব্য। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো মুক্তিযুদ্ধ, শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন সেই মহাকাব্যের মহানায়ক, বাঙালি জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজকে আমরা যে স্বাধীন দেশের নাগরিক, তা হতে পারতাম না, বাংলাদেশই হতো না।
মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে। এক কোটির উপরে মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়। আমরা মুক্তিযোদ্ধারাও প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিলো। আমরা নয় মাস যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছি। এ যুদ্ধে জাতি অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে। ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার অশ্রæ ও রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর মেধা, বুদ্ধি, সাহস, দূরদর্শিতা সাংগঠনিক দক্ষতা, কৌশল আর নেতৃত্ব-সবকিছু মিলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ না হলেও তাঁকে একাধিকবার দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তিনি সাংগঠনিক কারণে চট্টগ্রামে এসে কর্মিসভা এবং জনসভা করেছেন। চট্টগ্রামের নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করতেন। এ সুবাদে তাঁকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং তাঁর বক্তৃতা শুনেছি।
বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি যখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র, তখন থেকে সংগঠন করতেন। এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাÐে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তিনি ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার ‘ইসলামিয়া কলেজে’ ভর্তি হন। এই কলেজটি এখন ‘মওলানা আজাদ কলেজ’ নামে পরিচিত। কলেজে অধ্যয়নকালে বঙ্গবন্ধু বেকার হোস্টেলে থাকতেন। ঐ হোস্টেলের ২৪নং কক্ষের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ঐ কক্ষটিকে তাঁর স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণের লক্ষে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ’ নামকরণ করেছে। কক্ষের সম্মুখে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্যও স্থাপন করা হয়েছে। ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে বঙ্গবন্ধু পুরোপুরি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতনেতা (ইড়ৎহ খবধফবৎ)। তিনি নেতৃত্বের ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন এবং অতি অল্প বয়সে তাঁর এই ক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছিলো। ছোটবেলা থেকে তিনি একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং তাঁর ক্যাবিনেটের বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে গিয়েছিলেন। শেখ মুজিব মন্ত্রীদ্বয়ের সফর উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা ছিলেন।
দুই নেতা সফরকালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলও পরিদর্শন করেন। ওইস্কুলেই কিশোর মুজিব পড়াশুনা করতেন। কিশোর মুজিব ওই দিন (১৬ জানুয়ারি, ১৯৩৮) স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রীর পথরোধ করে দাঁড়ান। তিনি দুই মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদের স্কুলের ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে, আমরা ক্লাস করতে পারি না। আমাদের স্কুলের ছাদ মেরামতের আশ্বাস না দিলে আমরা আপনাদের পথ ছাড়বো না। কিশোর মুজিবের দৃঢ়তা দেখে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তাঁর ঐচ্ছিক তহবিল থেকে বারশত টাকা প্রদান করেন। দুই মন্ত্রী স্কুল পরিদর্শন শেষে ডাক বাংলোতে ফিরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে সেদিনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেন। কে এই কিশোর, কার এতো সাহস এবং বুকের পাটা যে বাংলার প্রধানমন্ত্রীর পথ আটকে দাঁড়ায়। খবর নিয়ে জানতে পারলেন এই কিশোরের নাম ‘শেখ মুজিব’, টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে। দুই মন্ত্রী তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘শেখ মুজিব ভবিষ্যতে একজন বড় নেতা হবেন।’ সেই কিশোর সত্যিই বাঙলার দু’নেতার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত করে পরবর্তীকালে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা এবং বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ‘বঙ্গবন্ধু’ হন।
১৯৩৮ সাল থেকে বলতে গেলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পথচলা শুরু। হোসেন সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধুকে কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে দীক্ষা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৩৯ সালে মুসলিম লীগের সদস্য হন এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িত হন। তখন অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। ১৯৪৬ সালে লক্ষে সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু একজন ছাত্রনেতা হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সেটি ছিলো ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলো। পাকিস্তান যখন হলো বঙ্গবন্ধু তখন কলকাতায়।
বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসার প্রস্তুতি নিলেন। ঢাকায় চলে আসার আগে ইসলামিয়া কলেজের সিরাজদ্দৌলা হলে বঙ্গবন্ধু তাঁর কিছু বিশ্বস্থ সহকর্মীকে নিয়ে একটি গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তাদেরকে বলেছিলেন পাকিস্তান স্বাধীন হলেও প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে না। প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য ঢাকায় গিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসে ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের অনুসারীদের প্রতিষ্ঠিত কর্মীশিবিরে যোগদান করেন। সেদিন থেকে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা, যিনি গোটা পাকিস্তানি জমানায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে অনমনীয় ও অবিচল ছিলেন। তাঁর সমস্ত আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক আফসান চৌধুরীর গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারছি, পাকিস্তানের জন্মের শুরু বা কিছু আগে থেকেই গোপনে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন কোন কোন মহল। তাঁদের এসব উদ্যোগের মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে সামনে রেখেই স্বাধীনতার গোপন পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরী নামে একজন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী ‘ইনার গ্রæপ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতার জন্য বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন নেতাজী সুভাষ বসুর মতো বঙ্গবন্ধুকে ভারতের মধ্য দিয়ে লন্ডন নিয়ে গিয়ে একটি প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালে আগরতলা গিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের ত্রুটির কারণে বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। ১৯৬৪ সালে ইনার গ্রুপের উদ্যোগে আবার শেখ মুজিবকে বিলেতে নিয়ে যাওয়ার একটি চেষ্টা হয়। কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হয়ে যায়।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেওয়া হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানকে ধ্বংস করার বীজ রোপন করেন। ছাত্রলীগই পরবর্তীকালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। ছাত্রলীগ ছিলো একটি ‘মেয়াদী বোমা’, যা’ ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন এবং ১৯৭১ সালে তার বিস্ফোরণ ঘটেছিলো; ফলশ্রæতিতে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। কারাগারে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক করা হয়। ওই সময় আওয়ামী লীগে অনেক বর্ষীয়ান নেতা ছিলেন। তারপরও বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতা এবং যোগ্যতার কারণে তাঁকে যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক।
এটি ছিলো আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটি। এরপর ১৯৫৪ সালে যুক্তপ্রন্টের নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময় এমপিদের বলা হতো এমএলএ (মেম্বার অব দ্যা লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলী), অর্থাৎ আইনসভার সদস্য। তখনো কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান হয়নি, এটিকে বলা হতো ‘পূর্ববঙ্গ’। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভারও সদস্য ছিলেন। কিন্তু পশ্চিমা সামরিক-বেসামরিক আমলারা বাঙালিকে ক্ষমতায় থাকতে দেয় নি। ষড়যন্ত্র করে বাতিল করে দেয় যুক্তফ্রন্ট সরকার।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের নানা ঘটনা সংঘটিত হয়। দুই পর্যায়ে ভাষা আন্দোলন হয়। ১৯৪৮ সাল হলে ১৯৫০ সাল এক পর্যায় এবং ১৯৫১ সাল হতে ১৯৫২ সাল হলো দ্বিতীয় পর্যায়। ’৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্ত। এদিন ঢাকায় সালাম, রফিক, বরকত, শফিউর ও জব্বার শহীদ হন। পুরো আন্দোলনটি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, পরবর্তীকালে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর ব্যানারে পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবক্রমে এসব গঠিত হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। তাঁকে জরিমানা করা হয় এবং জরিমানা না দেয়ায় তাঁর ছাত্র জীবন শেষ হয়ে যায়। ১৯৪৯-এর ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ে বেতনভুক কর্মচারীদের ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্র নেতৃবন্দ তার সমর্থনে সভা করে। ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা প্রচন্ড বিক্ষোভ শুরু করেন, যা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালে ২৯ মার্চ বহু ছাত্রকে নানা ধরণের শাস্তি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, নঈমুদ্দিন আহমদ, কল্যাণ দাশগুপ্ত, মিস নাদেরা নেগম ও আবদুল ওয়াদুদকে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিল। জরিমানা দিতে অস্বীকার করায় শেখ মুজিবকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। বিভিন্ন হল থেকে আবদুর রহমান চৌধুরী, মোল্লা জালাউদ্দিন ও আবদুস সামাদসহ ১৪জনকে বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় দবিরুল ইসলাম ও অলি আহাদসহ ৬জনকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদের নানা ধরনের কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম ছিলো অবস্থান ধর্মঘট। ১৯৪৯ সালের ২০ এপ্রিল হরতাল ডাকা হয়। অবস্থান ধর্মঘটের সময় শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং কোনো জরিমানা ও মুচলেকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে ১৯৪৯-এর ২৭ জুলাই পর্যন্ত জেলে থাকতে হয়। (মোনায়েম সরকার-আশফাক-উল আলম : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃ. ৭৯; প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ২০১১, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, আগামী প্রকাশনী।)
৬১ বছর পর, ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের এক বিশেষ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর মরণোত্তর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাগারে। কারাগারে তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীদের ডেকে নিয়ে গোপনে আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। ভাষা আন্দোলনে একবার আপোস করার চেষ্টা করা হয়। ভাষা আান্দোলনের একজন নেতা অলি আহাদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘সেদিন যদি মুজিব ভাই না আসতেন, তাহলে ষড়যন্ত্রকারীরা ভাষা আন্দোলন মাঝপথে থামিয়ে দিতো। এ প্রসঙ্গে ভাষা সংগ্রামী এডভোকেট গাজী উল হকের বক্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। ১১ মার্চে (১৯৪৮) পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। ১০ মার্চে রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা বসলো। সভায় আপসকারীদের ষড়যন্ত্র শুরু হলো। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবায়কসহ অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছে, আপস করতে চাইছে সরকারের সঙ্গে। একটা বজ্রকণ্ঠ সচকিত হয়ে উঠলো, সরকার কি আপস প্রস্তাব দিয়েছে ? নাজিমউদ্দীন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। এই বজ্রকণ্ঠ ছিল শেখ মুজিবের। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, মোগলটুলীর শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। আপসকামীদের ষড়যন্ত্র ভেসে গেলো।’ (মাযহারুল ইসলাম : ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (ঢাকা : বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র) পৃ. ২৪-২৫)
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র উপহার দেন এবং যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করেন। পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনার বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখার ওপর জোর দেন এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নাম ‘পূর্ব বাংলা’ রাখার দাবি জানান। তিনি পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিরোধিতা করেন এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
পাকিস্তান গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি জেনারেলরা সামরিক শাসন দিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। তখনই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পারলেন, পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাঙালি পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায়ও যেতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৮ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে ভাবতে শুরু করলেন আলাদা একটি দেশ প্রতিষ্ঠার। ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬১ সাল শেষার্ধের পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু গোপনে বিভিন্ন বৈঠক করে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬১ সালের কোনো এক সময় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তাঁর বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি তখন রাজি হয়নি। ডা. মোহাম্মদ হাননান রচিত ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। হাননান লিখেছেন, ১৯৬২ সালের শেষার্ধ থেকে বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকে হয়। সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ও ব্যাপারে দুই দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। আওয়ামী লীগ থেকে শেখ মুজিব ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মণি সিংহ ও খোকা রায় এসব গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।…………বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব কর্মসূচিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বৈঠকে বলেন : ওদের সাথে আমাদের আর থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলনের প্রোগ্রামে ঐ দাবি রাখতে হবে।’ (ড. মোহাম্মদ হাননান : বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১; তৃতীয় মুদ্রণ, ২০০৬, আগামী প্রকাশনী, পৃ. ২৩২-২৩৩) কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য নীতিগতভাবে উক্ত প্রস্তাবে একমত হয়েও
তখনকার পরিস্থিতিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি একটি হঠকারী দাবি হবে বলে তখন তা গ্রহণ করতে আপত্তি জানায়।
১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু গোপনে ছাত্রলীগ নেতাদের স্বাধীনতার জন্য ক্যাডার তৈরি করার নির্দেশ দেন। যার ফলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ‘নিউক্লিয়াস’ নামে একটি গোপন সেল সৃষ্টি হয়েছিলো। ১৯৬২ সালে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরোনামে পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলিতে অভিন্ন সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু এ সময় থেকে বা আরো সঠিক করে বলতে গেলে ভাষা আন্দোলনের পর থেকে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির চর্চা আরম্ভ করেছিলেন। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু সচেতনভাবে আওয়ামী লীগে আরো একটি জিনিস চালু করেছিলেন। সেটি হলো আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীসভা বা জনসভা যাই হোক না কেন, তা’ আরম্ভের পূর্বে কোরান, গীতা, ত্রিপিঠক ও বাইবেল পাঠ করা। অন্যদিকে মুসলিম লীগের সভা আরম্ভ হতো শুধু কোরান তেলাওয়াত করে। বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যতে যে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন, তার প্রস্তুতি যেন, তখন থেকেই শুরু করেছিলেন। এভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত একটি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধটি হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে এক হাজার মাইলের ব্যবধান। প্রতিরক্ষার সবকিছু পাকিস্তানে ছিলো, পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কিছু ছিলো না। ওই সময় ১৫ দিনের যুদ্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত ছিলো। বাঙালিরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু পাক-ভারত যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধীদলের বিষয় নির্বাচনী কমিটির বৈঠকে এবং পরে ২৫ ফেব্রæয়ারি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দানে এক জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
ছয়দফায় স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়। পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র হবে। বৈদেশিক নীতি ও প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের হাতে থাকবে, বাকিগুলো থাকবে ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের কথাও বঙ্গবন্ধু ৬ দফায় বলেন।
বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ঘোষণার আরো কারণ ছিলো। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে বাঙালিরা নানাভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক চাকরি, শিক্ষা, উন্নয়নসহ সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে (বাংলাদেশ) অবহেলা করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীতে উচ্চপদে কোন বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন না। সব বড় পদে ছিলো পাঞ্জাবি অফিসার। একটি দেশের পশ্চিম অংশে এতো সুযোগ-সুবিধা, অন্যদিকে পূর্ব অংশ কেনো বঞ্চিত হবে-এ বঞ্চনা আর জ¦ালা-যন্ত্রণা বঙ্গবন্ধু সহ্য করতে পারেন নি। শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার অপরাধে আমার জাতির উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা নির্মম অত্যাচার করছেন বঙ্গবন্ধু এ উপলব্ধি থেকে ছয় দফা দেন। কারণ ছয় দফা বাস্তবায়ন হলে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রদেশ হবে, আলাদা বাজেট ও উন্নয়ন হবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা এতে বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ খুঁজে পেল। ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে সকাল-সন্ধ্যা গ্রেফতার করা হয়। তাঁকে সকালে গ্রেফতার করে সন্ধ্যায় মুক্তি, সন্ধ্যায় গ্রেফতার করে পরের দিন মুক্তি-এভাবে গ্রেফতার করে এক জেল থেকে আরেক জেলে পাঠিয়ে চরম হয়রানি করা হয়।
বাঙালিদের মধ্যে ছয়দফা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতি ছয়দফাকে তাদের ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে গ্রহণ করে। যে কারণে মানুষ ছয়দফার ভিত্তিতে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলন যখন তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছিলো তখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ নামে একটি মামলা দেয় পাকিস্তান সরকার। প্রথমে এ মামলার নাম ছিলো-‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের উৎসাহে মিডিয়ায় মামলাটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিতি পায়। আগরতলা ভারতের একটি রাজ্যের রাজধানী। মামলায় এই নাম জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ভারতের দালাল প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলো। শেখ মুজিব ভারতের সাহায্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে এটাই মানুষকে বুঝাতে চেয়েছিলো পাকিস্তান সরকার। কিন্তু মানুষ বুঝতে পারে যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা ৬ দফা না মানার জন্য এ মামলা দায়ের করেছে। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথিত অভিযোগে ফাঁসি দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। তখন বাঙালিরা ছয়দফা আন্দোলনের সঙ্গে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বাতিলের দাবি যুক্ত করে তীব্র আন্দোলন শুরু করে।
‘ছয়দফা আন্দোলন’ এক পর্যায়ে‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বাতিলের আন্দোলনে রূপ লাভ করে। এ আন্দোলন ‘৬৯ এর প্রথমদিকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে। বাঙালি জাতির গণঅভ্যুত্থানের মুখে পশ্চিম পাকিস্তানের ‘লৌহ মানব’ খ্যাত আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল আসামিদের মুক্তি দেওয়া হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগার থেকে মুক্তির পর ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংবর্ধনা প্রদান করে এবং সেই সভায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন ৩৫ জন। বঙ্গবন্ধুর সাথে চট্টগ্রাম থেকে তিন রাজনীতিবিদকে এ মামলার আসামি করা হয়। তাঁরা হলেন, ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী (চট্টগ্রামের পটিয়া থানার হাবিলাসদ্বীপ গ্রামের বাসিন্দা), বিধান কৃষ্ণ সেন (চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার সারোয়াতলী গ্রাম নিবাসী) এবং ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী (চট্টগ্রামের এনায়েত বাজার নিবাসী)।
আগরতলা মামলার সত্যতা পাকিস্তান আমলে দেশের পরিস্থিতির কারণে অস্বীকার করা হলেও এখন স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে, বঙ্গবন্ধু সত্যিই বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈন্যদের দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত ক্যান্টনমেন্টে একযোগে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি যাকে কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো, তার বিশ্বাসঘাতকতায় পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মাণিক চৌধুরী-যাঁর সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো, তিনি, ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী ও বিধান কৃষ্ণ সেন এবং বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, লিডিং সী ম্যান সুলতান উদ্দিন, পিআইএর ম্যানেজার রমিজ সাহেব এবং সিএসপি অফিসার রুহুল কুদ্দুস, আহমদ ফজলুর রহমান ও খান শামসুর রহমান প্রমুখকে নিয়ে স্বাধীনতার জন্য গোপন বিপ্লবের প্রস্তুতি অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু মাণিক চৌধুরীকে নিয়ে চট্টগ্রামে ‘নতুন এজেন্সি’ নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খাড়া করে তার আড়ালে বৈপ্লবিক কর্মকাÐ পরিচালনা করতেন। তারা গোপনে এনায়েত বাজার চৈতন্যগলিতে ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরীর বাসভবনে মিলিত হয়ে শলা পরামর্শ করতেন। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম, স্টুয়ার্ড মুজিব, লিডিং সী ম্যান সুলতান উদ্দিন ডা. ছৈয়দের বাসায় যেতেন।
আইয়ুব খানের আমলে জনগণের ভোটের অধিকার ছিলো না। ছিলো মৌলিক গণতন্ত্র, অর্থাৎ মানুষ বিডি মেম্বার নির্বাচিত করতো। এই বিডি সিস্টেম মানুষের হাসির খোরাক হয়েছিলো। বিডি মেম্বারদেরকে মানুষ বলতে শুরু করেছিলো ‘৮০ হাজার ফেরেশতা’ বলে। ওই মেম্বাররাই ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি (এমএনএ ও এমপিএ) নির্বাচিত করতো। তারও আগে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আলাদাভাবে ভোট হতো। অর্থাৎ হিন্দু এবং মুসলমানরা আলাদাভাবে ভোট দিতেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ধর্মীয়ভিত্তিতে আলাদা নির্বাচনের প্রথা বাতিল করে যুক্ত নির্বাচনের প্রথা প্রবর্তন করে। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে এক ব্যক্তির একটি ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের (এমএনএ-মেম্বার অব দ্যা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলী) এবং একই বছরের ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের (এমপিএ-মেম্বার অব দ্যা প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলী) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ মহিলা আসনসহ ১৬৭টি আসন লাভ করে। ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি পায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৮টি আসন। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন লাভ করে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তরের কথা। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সেদিকে যায়নি। পাকিস্তানিরা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়নি, তারা চায়নি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হোক। যার ফলে স্বাধীনতার জন্য ’৭১ এর যুদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে সর্বশেষ ’৭০ এর নির্বাচনী প্রচারণার জন্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় নির্বাচনী প্রচারণায় যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর গাড়ির বহরে থাকা একটি গাড়ি দুর্ঘটনা কবলিত হয়। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি হারুন ঐ গাড়িতে ছিলেন এবং সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে ১৯৭১ এর ফেব্রæয়ারিতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ‘সোয়াত’ নামে একটি পাকিস্তানি জাহাজ নোঙর করে। ওই জাহাজে করে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের হত্যা করার জন্য অস্ত্র নিয়ে আসে।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামের স্বাধীনতাকামী মানুষ বন্দরের জেটিতে জমায়েত হতে থাকে। পাকিস্তানিরা যাতে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে না পারে, সেজন্য ২৪ মার্চ হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল তৈরি করে। এটি ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রথম প্রতিরোধ। তার আগে ‘৭১ এর ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন ঘোষণা দিলেন ৩ মার্চ পূর্বাহূত সংসদ অধিবেশন বসবেনা, সেদিন সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাস্তায় নেমে আসে।
সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষে আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। এভাবে শুরু হলো স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার অংশগ্রহণ। ’৭১ এর ২৪ মার্চের পরের দিন (২৫ মার্চ) রাতে চট্টগ্রাম শহরের স্টেশন রোডে আওয়ামী লীগের অফিসে (বর্তমান মোটেল সৈকত) অবস্থান করি। আওয়ামী লীগ অফিসে একটি কন্ট্রোল রুম ছিলো। রাতে সাগর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণের প্রচন্ড শব্দের বিভীষিকার মধ্যে সারারাত কাটাই।
আমি খুব অল্পবয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি। আমার বয়স ছিল তখন ১৮ বছর। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী ছিলাম। আমি এক নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করি। চট্টগ্রাম ছিলো এক নম্বরের সেক্টরের অধীন। এপ্রিলের প্রথম দিকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাই। সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ভারত থেকে দেশে ফেরার পথে বিভিন্ন স্থানে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় পাকিস্তানিরা। জায়গাটি সম্ভবত চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কোনো অঞ্চল হবে। ওই সময় আমাদের সাথে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নুরুল আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মোহাম্মদ ইদ্রিস, বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগ নেতা এস এম জামাল উদ্দিন, হাটহাজারী নিবাসী চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আফসার (পরবর্তীকালে খাদ্য ও চিনি শিল্প সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা) এবং কমার্স কলেজের ছাত্রনেতা আবুল হাসেম ছিলেন। এদিন সম্ভবত যুইগ্যাছোলা বাজারে আমাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকক্ষণ সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিলো।
ভারতের বৈষ্ণবপুর সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি, রাউজান হয়ে কর্ণফুলী ও হালদা নদী পার হয়ে বোয়ালখালী এবং সর্বশেষ পটিয়া যাই। এসব জায়গা দিয়ে আসার পথে খন্ড খন্ড অনেক যুদ্ধ হয়। ভারত থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া ও বাঁশখালী উপজেলায় যুদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়ে আমি ও আমার পাঁচ সহযোদ্ধা এসেছিলাম। আমি প্রথমে এফএফ, পরে বিএলএফের সদস্য হই। আমাদের গ্রুপটা ছিলো দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম বিএলএফ গ্রুপ। আমাদের গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন পটিয়া থানার রশিদাবাদ গ্রামের অধিবাসী নুরুল আনোয়ার, তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আনোয়ারা থানা নিবাসী ইদ্রিস আনোয়ারী। তিনিও শহীদ হন। আমার আর দুইজন সহযোদ্ধার নাম মনে আছে, একজনের নাম মনে নেই। এই দু’জন সহযোদ্ধা হলেন অজিত ও রণজিত।
চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া ও বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলাধীন বরকল গ্রামে শাহজাহান ইসলামাবাদীর ঘাঁটিতে আমরা যাই। শাহজাহান ইসলামাবাদী ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সাহিত্যিক-সাংবাদিক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পুত্র। বরকল ও বরমা ছিলো তখন মুক্ত এলাকা। শাহজাহান ইসলামাবাদীর সেল্টার থেকে আমি কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। তন্মধ্যে একটি বড় অপারেশন ছিলো আনোয়ারা থানা অপারেশন। আমিও এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। আমাদের গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন সার্জেন্ট মহি আলম। তিনিই আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আনোয়ারা থানা ছিলো পুলিশ এবং রাজাকারের শক্ত ঘাঁটি। আমরা মরণপণ লড়াই করে ওই সম্মুখ যুদ্ধে জয়লাভ করি।
আনোয়ারা থানাধীন ওষখাইন গ্রামে ‘টিক্কা খান’ নামে একজন কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। তার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। সাধারণ মানুষও তার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলো। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলাধীন কানাইমাদারী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিলদার আবু ইসলামের নেতৃত্বে আমরা রাজাকার টিক্কা খানের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে হত্যা করি।
চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরার একটি দোকানে রাজাকারদের ঘাঁটি ছিলো। মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু এস এম মাহবুবুল আলম ও আমি রাজাকারদের ওই ঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। এক রাতে ওই ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে আমরা ছ’সাত জন রাজাকারকে খতম করি।
আমার জন্মস্থান চট্টগ্রামের পটিয়া থানার হুলাইন গ্রাম। ’৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিন-চারদিন পর পরিবারের কাউকে না জানিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পটিয়া থেকে প্রথমে বোয়ালখালী থানার কানুনগোপাড়ায় আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাই। সেখান থেকে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে রাঙ্গুনিয়া থানার ইছামতি গ্রামে যাই। সেখানে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বিপ্রদাশ বড়–য়ার বাড়ি। তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। স্যার আর আমি পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিই। পথিমধ্যে রাত হয়ে যাওয়ায় পথঘাট কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। চারিদিকে শুধু পাহাড়, মাঝখানে একটি ছোট সমতল জায়গায় একটি ঘর দেখলাম। ঘরটি ছিলো এক পাহাড়ির। আশ্রয়ের আশায় আমরা তার বাড়িতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম। একজন লোক ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় জানার পর বাড়ির কর্তা আমাদের বললেন, ‘বাঙালিদের আশ্রয় দেব না, তাদেরকে আমরা ভয় করি’। ওই সময় ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাহিনী সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরে আক্রমণ করে লুটপাট ও জ¦ালিয়ে দিচ্ছিলো। এ কারণে তাদের মধ্যে ভয়। তাদের বললাম-আমরা সাধারণ মানুষ। এটা বলার পর তাঁর মন কিছুটা নরম হয়। এবার বললেন, ঠিক আছে, তোমরা থাকতে পারো, কিন্তু থাকতে হবে আমাদের গোয়ালঘরে। দয়া করে আমাদের কিছু খেতেও দিলেন তিনি। তারপরে আমরা গোয়ালঘরে চলে গেলাম। গোয়াল ঘরের এক পাশে গরু-ছাগল, আরেক পাশে আমরা দুইজন। সারারাত গরু-ছাগলগুলি মল-মূত্র ত্যাগ করছিলো, আর আমরা তার দুঃসহ দুর্গন্ধের মধ্যে রাত্রি যাপন করি। এটি ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি করুণ ঘটনা।
এছাড়া, স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতি হলো পঁচিশে মার্চের রাত। যে রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অত্যাধুনিক ভারি মারণাস্ত্র নিয়ে ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মানবেতিহাসের ভয়াবহতম, নিষ্ঠুরতম গণহত্যায় মেতে উঠেছিলো। সে রাতে আমি ও আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী প্রকৌশলী ইউসুফ চৌধুরী স্টেশন রোডে রেস্ট হাউসে ছিলাম। রেস্ট হাউসে ছিলো শহর আওয়ামী লীগের অফিস। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ক’দিন রেস্ট হাউসকে কন্ট্রোল রুম বানিয়ে শহরের প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়েছিলো। সে কী বিভীষিকাময় রাত। সারারাত সাগর থেকে পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ ‘বাবর’ থেকে শহরের ওপর গোলাবর্ষণ করা হয়েছিলো। আগুনের গোলা ছুটে ছুটে আসছিলো, আর আগুনের ফুলকি অন্ধকার চিরে আকাশে আলোর রোশনাই ছড়িয়ে দিচ্ছিলো।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ডিসেম্বরের একেবারে শুরুতে আমি হানাদার বাহিনীর সহযোগি আলবদর বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হই। আমি তখন নগরীর আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী সড়কে বর্তমান সিটি মেয়র আ.জ.ম. নাছির উদ্দিনের বাসায় আত্মগোপন করে ছিলাম। সেটি ছিলো আমার গোপন সেল্টার।
কিন্তু কিভাবে যেন আমার সেখানে লুকিয়ে থাকার খবর ফাঁস হয়ে যায়। আমাকে ওই বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নগরীর টেলিগ্রাফ রোড সংলগ্ন ডালিম হোটেলে রাখা হয়। ডালিম হোটেল ছিলো আলবদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ও প্রধান নির্যাতন কেন্দ্র। এছাড়া আরো দুটি টর্চার সেল ছিলো-একটি হলো নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদাম এবং অপরটি দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল। তবে হানাদার বাহিনীর প্রধান টর্চার সেল (সদর দপ্তর) ছিলো চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজ। এছাড়া ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাসভবন-গুডসহিলও একটি নির্যাতন কেন্দ্র ছিলো।
গুডসহিলে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হতো, অনেককে হত্যা করা হয়। আমাকে নির্যাতন করা হয় ডালিম হোটেলে। সেখানে আমার উপর এমন পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়, যার অনেক কিছু প্রকাশ করার মতো নয়। যেমন কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পর, লাঠিপেঠা, পা উপরে ছাদের বিমের সাথে বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে লোহার রড দিয়ে পেটানো, শরীরে সিগারেটের ছ্যাকা দেওয়াসহ নানা পদ্ধতিতে আল বদর বাহিনী নির্যাতন চালিয়েছে। আমার সহযোদ্ধাদেরও একইভাবে নিযাতন করা হয়েছে। অনেককে আলবদর বাহিনী মেরেও ফেলেছে।
’৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর থেকে আলবদর বাহিনীর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো না। ১৬ ডিসেম্বর ডালিম হোটেলের পাশর্^বর্তী হাজারী গলি থেকে আনন্দ-উচ্ছ¦াসের আওয়াজ শোনা গেলো। উৎফুল্ল জনতা ডালিম হোটেলের তালা ভেঙ্গে ফেলে আমাদের মুক্ত করে। তার আগে আলবদর বাহিনী পালিয়ে যায়। লোকজন আমাদেরকে এই বলে মুক্ত করেন যে, আপনার বেরিয়ে আসুন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আপনারা মুক্ত।
স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রথম শহীদ হন চারজন। তাঁরা হলেন-ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর চাচা বশরুজ্জামান চৌধুরী (আনোয়ারা), জাফর আহমদ (মাদারবাড়ি), দীপক বড়–য়া (এনায়েতবাজার) এবং মাহবুবুল আলম চৌধুরী (ফটিকছড়ি)।
তাঁরা একটি গাড়িতে করে শহরের উপকণ্ঠে যুদ্ধরত ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের জন্য রসদ নিয়ে যাচ্ছিলেন। চেরাগী পাহাড়ে যাওয়া মাত্র তাদের গাড়িটি পাকিস্তানি নৌকমান্ডোদের হামলার শিকার হয়। কমান্ডোরা ডিসি হিলে ওঁৎ পেতে ছিলো। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গাড়ি দেখতে পেয়ে ব্রাশ ফায়ার করে চারজনকেই হত্যা করে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রসঙ্গে বেতার কর্মী ও কলাকুশলীদের নাম আসে। কিন্তু এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগেরও যে কিছু অবদান আছে সে কথা কারো মুখে শুনি না। আমাদের দেশে একটা সাধারণ প্রবণতা হলো কোন বিষয়ে আওয়ামী লীগের যদি কোন কৃতিত্ব প্রাপ্যও হয়, সেটা স্বীকার করতে সবার মধ্যে একটা কুণ্ঠা বা দ্বিধা কাজ করে। আওয়ামী লীগকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করতে পারলেই যেন বিরাট কাজ হয়ে যায়। বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম বেতারের ট্রান্সমিশন কেন্দ্র খুঁজে বের করে সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করার জন্য আওয়ামী লীগই প্রথম সেটাকে একটা বেতার কেন্দ্র হিসেবে চালু করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দুপুরে আওয়ামী লীগের চালু করা ঐ বেতার কেন্দ্রকেই সন্ধ্যায় চালু করে বেতার কর্মীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামকরণ করেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণা দেশে-বিদেশে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পাঠানো হয়। রাতারাতি এ ঘোষণা সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে বিলির পাশাপাশি মাইকিং ও বিলি করা হয়। ওই দিন (২৬ মার্চ) সকাল বেলা আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর চট্টগ্রাম শহরের বাসা জুপিটার হাউসে দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের এক সভায় কিভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় সে ব্যাপারে আলোচনা হয়।
সভার পর আওয়ামী লীগের ওই সময়কার শীর্ষস্থানীয় নেতা এমএ হান্নান জুপিটার হাউস থেকে বের হয়ে প্রথমে আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। সেখানে তখন কেউ ছিলো না। একজন নিরাপত্তা রক্ষী বললো, সেই বেতার কেন্দ্র চালু করে মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা চালানো হলে কাছেই সমুদ্রে অবস্থানরত পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ থেকে শেলিং করে বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দেয়া হবে। সে-ই খবর দিলো বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম বেতারের একটি রিলে স্টেশন আছে, যেখান থেকে বেতার সম্প্রচার চালানো যাবে। হান্নান সাহেবের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন এবং এমএনএ আতাউর রহমান কায়সার, এমপিএ মোশাররফ হোসেন ও মির্জা মনসুর ছিলেন। তাঁরা আগ্রাবাদ থেকে বহদ্দারহাটের উদ্দেশে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে চকবাজারের বেতারের এক প্রকৌশলীকেও তাঁর বাসা থেকে ডেকে নেন। তারপর বেতার কেন্দ্র চালু করে দুপুর একটার দিকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। একই দিন সন্ধ্যায় বেতারকর্মী বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম স›দ্বীপ ও চট্টগ্রামের আমিনুর রহমান সহ অন্যান্য কলাকুশলীরা বেতার কেন্দ্রটি চালু করে এটির আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমে নামকরণ করলেন-‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’, পরে নাম দেওয়া হয়-‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’। পরের দিন ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্টম বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক) বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
মেজর জিয়া ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বিদ্রোহ করে চট্টগ্রাম শহরের ২নং গেইটে ৮ম বেঙ্গলের ছাউনি থেকে তাঁর অধীনস্থ অফিসার ও জোয়ানদের নিয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আবু মনসুর (ফটিকছড়ি) ও আতাউর রহমান কায়সার (আনোয়ারা) বোয়ালখালীর পূর্ব প্রান্তে করলডেঙ্গা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানরত জিয়ার সাথে সাক্ষাত করেন এবং জিয়াকে বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে পাঠ করার জন্য অনুরোধ করেন।
জাতীয় পতাকা তৈরীর ক্ষেত্রেও রয়েছে ইতিহাস। ঢাকা বিশ্বি বিদ্যালয়ের ইকবাল হলে ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রনেতারা জাতীয় পতাকার নকশা তৈরি করেন। তাঁরা পতাকার নকশা বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন এবং তাঁর অনুমোদন নেন। কুমিল্লার ছাত্রলীগ নেতা শিব নারায়ণ দাশ জাতীয় পতাকার নকশা তৈরি করেন। নকশাটি তৈরি করা হয় চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডর বাসিন্দা তৎকালীন ইউকসু ও বর্তমান বুয়েটের ছাত্র (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ সালাহাউদ্দীনের কক্ষে। প্রথমে বাংলাদেশের পতাকায় সবুজ রঙের উপর মানচিত্র ছিলো।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার অনুভূতি ছিলো অভাবনীয়। আমি তো ১৬ ডিসেম্বরই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাই। পুরো জাতি এক শাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে ছিলো। পাকিস্তানীরা পুরো দেশকে কারাগারে পরিণত করেছিলো। যে লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে সে লক্ষ্য পূরণ হওয়ার যে, কী আনন্দ, আবেগ এবং উচ্ছাস-তা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না। সাধারণ মানুষ দীর্ঘ নয় মাস চরম এক উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছে। সেই দুঃশাসন এবং দুর্বিষহ অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষ মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারলো। বাঙালি জাতি প্রাণ খুলে কথা বলতে পারলো, বাংলার আকাশে লাল-সবুজের পতাকা পতপত করে উড়তে লাগলো-এটাই তো স্বাধীনতাত্তোর একটি জাতির অনুভূতি। সর্বোপরি যুদ্ধ জয়ের অনির্বচনীয় আনন্দে আমরা যেন ফুরফুরে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। তবে আনন্দের মধ্যেও একটা বিষাদের ছায়া আমাদের অন্তরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। তার কারণ হলো বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে নেই। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে তিনি যতক্ষণ সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে না আসছেন, ততক্ষণ আমাদের বিজয় সম্পূর্ণ হবে না। তারপর একদিন সত্যিই তিনি আমাদের মধ্যে ফিরে আসলেন। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সম্পূর্ণ বিজয় অর্জিত হয়।
বঙ্গবন্ধু একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পেয়েছিলেন। পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছিলো। তারা রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, ফেরিসহ সমস্ত যোগাযোগ অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। টাকা-পয়সা লুটপাট করে নিয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন পোঁতা ছিলো। বন্দরে জাহাজ আসতে পারতো না। বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত নৌবাহিনীর সহায়তায় ডুবুরীদের নামিয়ে মাইন পরিষ্কার করে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ চলাচলের উপযোগি করে তোলেন। বঙ্গবন্ধু কল-কারখানা ও অফিস আদালত চালু করলেন। মানুষকে উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করলেন। নতুন করে ব্রিজ-কালভার্ট মেরামত করলেন। তিনি সবকিছু নতুন করে যাত্রা শুরু করেন। পৃথিবীর ১৩০টি দেশ থেকে স্বীকৃতি আদায় করেন। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে ইসলামি দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা দেন। এভাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে পরিণত করার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এটা মেনে নিতে না পেরে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু, তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগি এবং খন্দকার মোশতাক সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য দিয়ে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নং বাসভবন আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সকল সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, দেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করেছিলো। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, যে আদর্শের নাম গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সমস্ত অর্জন বর্জন করে, সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে দেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ‘মিনি পাকিস্তান’-এ পরিণত করার অপচেষ্টা চালায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে তোলেন। দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। দেশীয় টাকায় শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু করছেন। বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে। শেখ হাসিনা দেশকে বিকাশমান উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আড়াই মাসের মাথায় তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনাকারী জাতীয় চার নেতা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাউজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে ঢুকে ঘাতকেরা হত্যা করেছিলো। কারাগারকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান, নিরাপত্তা হেফাজত। আর সভ্য জগতের সামনে বাংলাদেশের মুখে চুনকালি লাগিয়ে তারা হত্যা করেছিলো জাতির চার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। তারা ভেবেছিলো এই হত্যাকান্ডের ফলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু তাদেরকে মিথ্যা প্রমাণিত করে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার হয়েছে। ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আমিও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ঘাতক মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছি। ঘাতক দালালদের বিচার করে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিচারের রায়ে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত অনেকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার অপরিসীম গর্ব হয়। কারণ তাঁর এ জালাময়ী বক্তৃতা ও বজ্রকণ্ঠ শুনে আমি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতিসংঘ বিশ্ব প্রামান্য ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটা জানতে পেরে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি এবং পুরো জাতি আনন্দিত ও গৌরবান্বিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ভাষণের শব্দ চয়ন-অলংকার ছিলো অতুলনীয়। এখনো সেই ভাষণ আমাকে আলোড়িত করে, শিহরিত করে।
বিবিসির জরিপে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু সি আর দাশ, সত্যজিৎ রায়, জগদীশ চন্দ্র বসুসহ অনেক বিশ্ব বরেণ্য বাঙালির নাম এসেছিলো। কিন্তু তাদের সবাইকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা, যিনি বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একাত্তর সালের পূর্বে ‘বাংলাদেশ’ নামে কোনো দেশ ছিলো না। বাঙালি নামে কোনো জাতিসত্ত্বা ছিলো না। বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করে বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছেন। আমরা যারা আজ বাঙালি, স্বাধীন দেশের নাগরিক, সেই দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিত্বের দাবিদার, আর কেউ তো তা হতে পারেন না। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসেবে আমার গর্ব ও অহংকার হয়, এমন একজন মহান নেতার ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
আরো একটি নতুন বছরে আমরা পথচলা আরম্ভ করেছি। এবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। জাতির পিতা ও স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীকে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ঘোষণা করেছে ‘মুজিববর্ষ’। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস থেকে ‘মুজিববর্ষের’ ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা, যাকে শত অত্যাচার করেও দমন করা যায় নি। তাঁকে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা যায় নি। তিনি একমাত্র নেতা, যিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনড় এবং অটল ছিলেন। পাকিস্তানের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা যেমন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আবুল মনসুর আহমদ, কমরেড মনি সিং, আতাউর রহমান খান এবং অলি আহাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মত তাঁর সমসাময়িক নেতারা দেশে ছিলেন। তারপর দেড় দশকের মধ্যে এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করে অতীত হয়ে যান। কিন্তু ৬৯ থেকে যখন পাকিস্তান দ্রুত পতনের পথে ধাবিত হচ্ছিলো, তখনও
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আবুল মনসুর আহমদ, কমরেড মনি সিং, আতাউর রহমান খান, অলি আহাদ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ-রা বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই বঙ্গবন্ধুর ধারে কাছেও ছিলেন না। ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তার পারদ উর্ধমুখী হতে হতে সত্তরের নির্বাচনের পর এভারেস্টের চড়ায় উন্নীত হয়। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের চূড়ায় আসীন করেছে। বঙ্গবন্ধুকে দুইবার ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। একবার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং আরেকবার মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর সেলের সামনে তাঁর কবর খোঁড়া হয়েছিলো। এসব করে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে ভয় দেখিয়েছিলো, কিন্তু জীবনের পরোয়া করেন নি বঙ্গবন্ধু। দেশ এবং জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের পরিবারকে সময় দিতে পারেন নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিয়ের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাগারে। শেখ হাসিনা এবং তাঁর স্বামীকে চট্টগ্রামে এনে বিবাহোত্তর সংবর্ধনা দিয়েছিলো তাঁর বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা। সারা দুনিয়ায় বঙ্গবন্ধুর মতো এমন ত্যাগী, তেজস্বী, জেদী এবং স্বাধীনতাপ্রেমী নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না।