বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত সেতু নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে পদ্মাসেতু খুঁটি গড়ে তোলা সবচেয়ে জটিল ও চ্যালেঞ্জিং ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে এর প্রধান কারণ ছিল নদীর তলদেশের ব্যতিক্রমী মাটির লেভেল। পদ্মা তার পানির স্রোতের সঙ্গে নিচ থেকে বিপুল পরিমাণে মাটি তুলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
এভাবে নদীর নিচের মাটি ক্ষয় হতে পারে ৬৫ মিটার বা ২১ তলা দালানের সমান। যে কারণে খুঁটি নিতে হয় আরও গভীরে। এই জটিল কারিগরি দিক বের করতে পদ্মার কাজ পিছিয়ে গিয়েছিল প্রায় এক বছর। এ রকম ক্ষয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল ২২ খুঁটির তলদেশে। যে কারণে ২২টি খুঁটির কাজ বন্ধ রেখে পুনরায় নকশা করে আনতে হয়েছিল। বিষয়টি জানিয়েছিলেন পদ্মাসেতুর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রধান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বের দীর্ঘতম ১২২ মিটার পাইল স্থাপন, ১৫ টন ওজনের ৯৮৭২৫ কিলো নিউটন ক্ষমতা সম্পন্ন ফিকশন প্যান্ডিলাম বেয়ারিং ব্যবহার ও নদী শাসনের সর্বোচ্চ ১.১ বিলিয়ন (প্রায় ৮ হাজার ৮শ’ কোটি) টাকা টাকার চুক্তি এইসব বিশ্ব রেকর্ড। এছাড়াও কোন নির্মাণ কাজে বিশ্বে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে ভার্টিক্যাল আরসিসি বোর্ড পাইলে গ্রাইটিং ইনজেক্ট স্কিন ফিকশন করে দৃড়তা বৃদ্ধি করে নদীর তলদেশে বহির্ভাবে শক্তি বৃদ্ধি। পদ্মায় এমন পাইল সংখ্যা ২২টি। অপরটি স্টিল টিউবুলার ড্রিভেন পাইলে গ্রাউটিং ইনজেক্ট করে পাইলের তলদেশের স্কিন ফিকশন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এমন পাইল সংখ্যা ২৫২টি।
ভূমিকম্প সহনশীল:
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজব আলী জানান, সেতুতে ১৫টন ওজনের ৯৮৭২৫ কিলো নিউটন ক্ষমতা সম্পন্ন ফিকশন প্যান্ডিলাম বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। যা উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প প্রতিরোধক । পুরো সেতুতে ৫ ধরণের ৯৬টি বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মধ্যে ৩৫টি স্প্যানের সাথে ২টি করে বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। আর সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টে ৪টি করে বেয়ারিং ব্যবহার হচ্ছে। ৬.১৫ কিলোমিটার সেতুতে মোট ৭টি জয়েন্ট থাকছে।
বিশ্ব রেকর্ড:
পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদী শাসনে চায়না সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনের সাথে সর্বোচ্চ প্রায় ৮ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার চুক্তি হয়। এটিও বিশ্ব রেকর্ড। নদী শাসনে এখনও পর্যন্ত এত বড় চুক্তি আর কোথাও হয়নি। পদ্মা সেতুর পাইলে ১ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বমোট ২৬৬ পাইল । আর পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যানের ওজন ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৮৮ মেট্রিক টন। প্রতিটি স্প্যানের সর্বোচ্চ ওজন ৩০ হাজার ৮৮ মে. টন।
পদ্মা সেতুর প্রতিটি পাইলের সক্ষমতা ১২৪.৬০ মেগা নিউটন। অর্থাৎ প্রায় ৮ হাজার ৭শ’ মেট্রিক টন। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে রয়েছে ১২.১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। পদ্মা সেতুতে ২৯৬০টি রেলওয়ে স্লাব এবং ২৯১৭টি রোডওয়ে স্লাব স্থাপন হচ্ছে। ইউরোপের লুক্সেমবার্গ থেকে আনা রেলওয়ে স্ট্যানজার স্থাপন হচ্ছে স্প্যানে চারটি করে। সেতুতে সাধারণ আলোর ব্যবস্থা ছাড়াও আর্কিটেকচার লাইটিংও থাকছে।
বিশেষ বিশেষ দিবস গুলোতে এবং বিশেষ সময়ে লাইটিংয়ের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। পদ্মা সেতুর ন্যাশনাল গ্রিডিংয়ের জন্য সেতুর ৫শ’ মিটার ভাটিতে পদ্মায় ৮টি বৈদ্যুতিক টাওয়ারের পাইল স্থাপন করা হয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়।
কোনও ব্যক্তি নয়, নদীর নামেই হবে ‘পদ্মা সেতু’:
কোনও ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের নেতার নামে নয়, নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর নামকরণ করা হবে পদ্মা নদীর নামেই। তাই নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুটি বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীর কাছে ‘পদ্মা সেতু’ নামেই পরিচিত হবে। এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আগেই জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর নাম নদীর নাম অনুসারে ‘পদ্মা সেতু’ থাকছে।