বাংলাদেশের মানুষ ফুল ভালোবাসে। আগে এ দেশে ফুলের কদর তেমন ছিল না। বর্তমানে এর চাহিদা ব্যাপক। এখন অনুষ্ঠানে
ফুলের ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক অনেক বেড়েছে। সেজন্য সরকার ফুল চাষ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চায়। এজন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন হচ্ছে।
যশোর জেলার ঝিকরগাছায় ফুল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক ২৩১ কোটি টাকা সংশোধিত ১৫৫ কোটি টাকা বাজেট করা হয়েছে। চলতি ২০২২ সালের জুন নাগাদ এই গবেষনা সেন্টার স্থাপন শেষ হওয়ার কথা। ফুল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশে ফুল ও শোভা বর্ধনকারী উদ্ভিদের উৎপাদন ২০ শতাংশ বৃদ্ধি ও ফুল জাতীয় পণ্য সংগ্রহের পর ১৫ শতাংশ ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে এ আশায় প্রকল্প কর্তারা।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রমে ঝিকরগাছায় ২০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ, পূর্ণাঙ্গ ও যুগোপযোগী ফুল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন অফিস ভবন, আবাসিক ভবন, সেচ অবকাঠামো, বিদ্যুৎ অবকাঠামো, অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ফার্মের অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ, গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার জন্য টিস্যু কালচার ল্যাব, পোস্টহার্ভেস্ট ল্যাব ও এনালাইটিক্যাল স্থাপন, প্রয়োজনীয় যানবাহন, ফার্নিচার, ল্যাব ও মাঠ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, বিভিন্ন ফুল ও শোভা বর্ধনকারী উদ্ভিদের ৫০০টি জার্মপ্নাজম সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মূল্যায়ন। ফুলের ১০ উন্নত জাত এবং ২০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্তারা জানান, প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন এর মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া প্রস্তাব পেয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। ব্যয় ১৫৫ কোটি টাকা। চলতি জুন মাসে এই সেন্টার স্থাপনের কাজ শেষ হবে। যশোর শহর থেকে ২০ কি:মি: দুরে গদখালী বাজার। ফুলের রাজধানী হিসেবে এটির পরিচিতি সারা দেশে।
দেশের ফুলের চাহিদার বড় অংশ জোগান দেন এখানকার চাষিরা। গদখালীর ৪০ শতাংশ ফুল ঢাকা ও চট্টগ্রাম এবং ৬০ শতাংশ ফুল পাইকারি দামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। তবে শুধু যশোর নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় ফুল উৎপাদন হচ্ছে। ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, নাটোর ও খুলনায় তা হচ্ছে।
সরকারি তথ্য মতে, দেশে ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফুল উৎপাদনে জড়িত। ফুলের পাইকারি বাজার ফিবছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। খুচরা বাজারে তা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটি ফুল চাষে সহায়ক। বর্তমানে দেশে প্রায় ১২০০০+ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়। অন্তত: ৫০,০০০ কৃষক ফুল চাষে সম্পৃক্ত। প্রায় ১০ লাখ লোকের জীবন- জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফুল বাণিজ্যে নির্ভরশীল। বাণিজ্যিক ফুল চাষে গ্রামীণ মহিলা ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
ঝিকরগাছা উপজেলাসহ যশোর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ হয় নানা জাতের ফুল। দেশের চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ যোগান যায় এখান থেকে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ফুল এখন আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিত লাভজনক পণ্য। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পানপাতাসহ ফুল রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলার।
এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে ফুল রপ্তানির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এদেশে ফুল চাষকে লাভজনক শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। শুধু আবহাওয়া নয়, তুলনামূলক কম পুঁজি বিনিয়োগ ও পণ্যের উচ্চমূল্য অন্যতম কারণ। লাভজনক এই ফসলটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে চাষির নিজস্ব উদ্যোগে চাষ হয়। এতে চাষিরা বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন।
ফুলের উন্নত জাত, ভালো বীজ চারা, আধুনিক প্রযুক্তি, মানসম্মত উপকরণ, কার্যকর সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তির অভাব এবং আধুনিক মানের অবকাঠামো সুযোগ- সুবিধার ঘাটতি এ শিল্প প্রসারে বাধা। এবাধা দূর করে ফুল শিল্প সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। যাতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ফুল রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন: বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সর্ত্তেও ১০টি ফুলের ১৯ জাত উদ্ভাবন করেছে এবং ফুল ও শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদের চাষ পদ্ধতি, ফুল সংগ্রহ প্রযুক্তি, প্যাকেজিং ইত্যাদি সম্পর্কিত ২০ কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছে। ফুল গবেষণা কার্যক্রম আরও বেগবান করতে ঝিকরগাছা উপজেলায় ফুল গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প প্রস্তাব এগিয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনি: সচিব) ড. শামসুল আলম জানান, বাংলাদেশে ফুল চাষের ব্যাপক ও উজ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে এখন ফুলের ব্যবহার বেড়েছে। পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির সুযোগ আছে। ফুলে বাণিজ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর চাষ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত
সময়োপযোগী।
দেশের মানুষের কাছে ফুলের জন্য গদখালী বিখ্যাত হলেও মূলত ফুলের কেন্দ্রবিন্দু পানিসারা গ্রাম। এ গ্রামের শের আলী সরদার। তিনি ১৯৮২ সালে ভারত থেকে কিছু গোলাপ ও রজনীগন্ধা ফুলের বীজ আনেন এবং নিজের কিছু জমিতে চাষ করেন। তবে বাণিজ্যিক চাষ ২০০৫সালে। দেশের বাজারে ফুলের ব্যাপক চাহিদা, ফুল চাষ ও ব্যবসা লাভ জনক বিধায় ২০১০ সালে বেশি কৃষক ফুলচাষে জড়ায়। এতে পাল্টে গেছে পানিসারা ও আশেপাশের গ্রামবাসীর জীবনযাত্রার মান ও আর্থিক অবস্থা।
২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত এলাকার প্রধান ফসল ছিল ধান, পাট, আলু সবজি পেপে চাষ। বর্তমানে ধান চাষ আছে তবে ফুল নিয়মিত চাষ হচ্ছে। গদখালীতে চাষাবাদের ৫ কাঠা জমি মালিক কৃষক তার ৩কাঠা জমিতে ফুল চাষ করে। সেখানে শতকরা ৯৮ ভাগ কৃষক ফুলচাষে জড়িত।
উপজেলা কৃষি সম্প্র: অফিসার মাহবুব আলম রনি জানান, গদখালীর ফুল চাষীদের কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝিকরগাছা ও পাশ্ববর্তী শার্শা উপজেলার মোট ৭৫ গ্রামে ৭০০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৮,০০০ কৃষক সরাসরি ফুল উৎপাদন করছে। এখানে চাষকৃত ফুলগুলো হচ্ছে গোলাপ, গøাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গাঁদা, জারবেরা ইত্যাদি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ জানান, বর্তমানে গদখালীর ২৭২ হে: জমিতে গ্লাডিওয়ালস, ১৬৫ হে: রজনীগন্ধা, ২২ হে: জারবেরা, ১০৫ হে: গোলাপ এবং ৫৫ হে: গাঁদা ও ৬ হে: জমিতে অন্যান্য ফুল চাষ হয়। উপজেলা কৃষি সম্প্র: অধি: তথ্যে গদখালীতে দৈনিক কয়েক লক্ষ টাকার ফুল বিক্রি হয় যা মাসিক দাড়ায় ৮/১০ কোটি টাকা। বার্ষিক তা ২০০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোস্যাটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, সারা বছর দেশের বাজারে ফুলের টুকটাক চাহিদা থাকে। তবে বেশি চাহিদা মূলত দেশের জাতীয় দিবস ও অনুষ্ঠান স্বাধীনতা দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১লা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, ঈদ এবং পূজা-পার্বনে।
পানিসারার মোড়ের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করছে ফুল চাষ। অতীতে এই স্থানে শুধুমাত্র টং দোকান ছাড়া কিছু ছিল না। অথচ খাবার হোটেল, চা-কফির দোকান, রেস্টুরেন্ট, ফুলের দোকান ও ছোটবড় অনেক নার্সারি থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে অনেক পরিবার। পানিসারা থেকে গদখালী বাজার তিন কি:মি:। এখানে প্রতি ভোর থেকে শুরু ফুলের বাজার। শেষ হয় সকাল ৮ টায়।
মূলত এ বাজার থেকে ফুল ব্যবসায়ীরা সরাসরি ফুলচাষীদের কাছ থেকে ফুল ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। গদখালীর ফুল পরিবহনে টঝঅওউ প্রায় ১০ কি:মি: পথ পাকা করে দিয়েছে। কৃষক ও সাধারণ মানুষের আরও উন্নত যোগাযোগে স্থাপন হয়েছে রবি ৪জি নেটওয়ার্ক টাওয়ার। অতীতে স্কুল কলেজের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা জীবিকার তাগিদে প্রবাসে পাড়ি জমাত। তারা এখন ফুলচাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন কর্মসংস্থানে। গদখালীর নাম ছড়িয়েছে দেশ ও দেশের বাইরে। এটি এখন জেলার প্রধান দর্শনীয় স্থান।
স্থানীয়দের তথ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন প্রায় গড়ে হাজারোর্ধ দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এলাকায়। শীত মৌসুমে তা কয়েক গুন বেড়ে যায়। অপার সম্ভাবনাময় গদখালীর ফুলচাষ। এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভবিষ্যতে অবদান রাখবে এই আশায় ইতোমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রকল্প ও উন্নয়ন কর্মসূচী গৃহিত হয়েছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মাহবুব আলম রনি জানান, গদখালীর ফুলচাষীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে টঝঅওউ এলাকায় পাকা রাস্তাঘাট ও কালভার্ট নির্মাণ করেছে। ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে কোল্ডস্টোর নির্মাণ হয়েছে।
মূলত ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এই তিন মাসে এখানে বেশি ফুল উৎপাদন হয়। তাই দর্শনার্থীরা ফুল উপভোগে এই সময় বেশি পছন্দ করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লক্ষ দর্শনার্থী ভিড় জমায় এখানে। তাদের জন্য তৈরি হচ্ছে হোটেল রেস্টুরেন্ট ও গেস্ট হাউজ। স্থানীয় ফুল চাষী ও ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর জানুয়ারি মাস গদখালী ফুল মেলা হিসেবে পালন করে।