আমাদের দেশ বা সমাজে এমন ক’জন কবি আছেন যাঁর কবিতা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আবৃত্তি করে শোনান? যাঁর কবিতা কণ্ঠে ধারণ করেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা? আমাদের তারুণ্যে জীবন ও যৌবনের দ্রোহকালীন আমরা তাঁর কবিতার কাছে হাত পাততাম। কারণ সে কবিতাগুলো ছিল দেশ ও মানুষের কথায় পূর্ন। তাঁর কবিতা ‘হুলিয়া’ কিংবা পঁচাত্তর পরবর্তী কালে ‘আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ এক দীর্ঘ ইতিহাস বিস্ময় আর কাব্যের অপূর্ব সংমিশ্রণ। যখন রাজনীতি ও স্তব্ধ মূক নির্বাক তখন জাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। এখনকার বাস্তবতায় যে দিকে তাকাবেন মুজিব কোটের বাহুল্যে আপনি ভাবতেও পারবেন না কেমন ছিল সে দিনকাল। সেই বৈরী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাও ছিল বিপজ্জনক। তাঁর নাম, ‘জয় বাংলা’ বা ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলা মানে বিপদ টেনে আনা। কত বড় বড় মানুষ কবি সাহিত্যিক ভোল পাল্টালেন। অথচ নির্মলেন্দু গুণ এসে দাঁড়িয়েছিলেন মানুষের সমুখে। কবি ও কবিতা হয়ে উঠেছিল ইতিহাস।
তিনি প্রেমের কবিও বটে। কিশোর বেলা পার হয়ে যখন গোঁফের রেখা জন্মেছে তখন পাঠ করেছিলাম: তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর। এমন উত্তেজনাপ্রবণ কবিতার পাশাপাশি ছিল:
গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল আমাদের চারিধারে
দেয়ালের মতো অনুভূতি মাখা মোম
জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমরা দেখেছি শিখার ভিতরে মুখ…
অপূর্ব সব কবিতায় আমাদের হৃদয়ে বাঙালির অন্তরে ঠাঁই করে নিচ্ছিলেন তিনি। পরে সময় গড়ালো। এই বড় কবির সাথে পরিচয় ঘটলো। অসম সখ্যও হয়েছিল। সে সূত্রে তাঁকে আরো জানার সুযোগ ঘটলো। জানলাম শুধু কবি তিনি নন, দারুণ রসিকজনও বটে। সে রসময়তা আছে তাঁর গদ্যে। বানিয়ে কৌতুক বলা না, চলমান ঘটনাও জীবন নিয়ে এমন রসবোধ বিরল। প্রথম যেবার বঙ্গবন্ধু পরিষদের আমন্ত্রণে সিডনি এলেন, একই মঞ্চে আলোচনা ও কবিতা পাঠের পর তাঁকে কিছুতেই খুঁজে পাই না। পরদিন স্থানীয় এক রেস্তরাঁয় দুপুরে ভোজ ও আড্ডার ছিল আয়োজন। সবাই এলেন কিন্তু অতিথি কবির দেখা নাই। তিনি আসলেন দেরীতে। ততক্ষণে হাসান ইমাম, লায়লা হাসানের কথা শেষ। কবির কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমানদের চমকে দিয়ে বললেন, এক এক করে পরিচয় দিতে। সবাই যে যার মতো প্রবাসী কায়দায় কার কত নামডাক কে কী করেন, দেশে তাদের কতটা সুনাম এসব বলা শুরু করলেন। শেষ হবার পর দাদা মাথাগুণে বললেন, এখানে আপনারা যত জন আছেন সবাই যদি পাঁচ ডলার করে দেন তো ভালো হয়। কাল রাতে ক্যাসিনোয় প্রায় সব হারিয়েছি। অজয় ও বিরূপাক্ষ ছাড়া সবাই পাঁচ ডলার করে দিলে আমার একটু সাশ্রয় হয়। রাতের ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া যায়। হকচকিয়ে যাওয়া সবাই এক এক করে টেবিলে টাকা রাখতে শুরু করল।
আমাদের টাকা দিতে নিষেধ করার কারণ ছিল আমরা লেখালেখি করি বলে গরীব শ্রেণির মানুষ। এমন কাজ তিনি আমেরিকায়ও করেছিলেন। সারারাত জুয়া খেলে সব হারিয়ে ভোরে একটি নামকরা কফিশপে কফির সাথে একের পর এক ফ্রি জেলির প্যাকেট সাবাড় করছিলেন খিদে মেটাতে। তাঁর এই কান্ড দেখে কাউন্টারের তরুণী মেয়েটি চোখ গোল গোল করে জানতে চেয়েছিল- সন্যাসী তুমি কোন দেশের লোক গো বাপু?
নির্মলেন্দু গুণ হঠাৎ চিন্তা করলেন বাংলাদেশ বলা মানেই নিজের দেশকে বিপদে ফেলা। মেয়েটি ভাববে বাংলাদেশের মানুষ মানেই এমন। এবং সবাইকে তা বলে বেড়াবে। তাই দেরী না করেই বলেছিলেন আমি ভারতের লোক। তাঁর ভাষায় দেশের ইজ্জত তো বাঁচলো, ভারতের যা হবার হোক।
তাঁর গদ্যে এমন অজস্র মজার কাহিনী আছে। এই রসিকতার ফাঁকেও দেখি গভীর সত্যের ঝলকানি। সেনাকুঞ্জে ভালোবাসা জানাতে ছুটে আসা সুন্দরী সেই নারী কবিকে বলেছিল, পরিচয় পেলে আপনি আমায় ঘৃণা করবেন। আত্মস্বীকৃত খুনীর সে পত্নীকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, মাতৃগর্ভে খুনীর জন্ম হয় না, খুনীর জন্ম সমাজগর্ভে- কী অসাধারণ উপলব্ধি।
এই মজার মানুষ যখন সিডনি এলেন দুপুরে বাসায় আসবেন খাবেন ও দিবানিদ্রা যাবেন। আনতে গিয়ে দেখি ভক্ত পরিবেষ্টিত কবি। এক অনুজ আবদার করলো তার গাড়িতে করে কবিকে আমার বাড়ি পৌঁছে দেবে। এই তার চাওয়া। তথাস্তু। দীর্ঘকায় কবি তার গাড়িতে উঠতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেলো দরজায়। মুহূর্ত বিলম্ব না করে পেছনে ফিরে হাসি মুখে বললেন, বুঝলা অজয়, লম্বা যতো আহম্মক ততো।
বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজনে টেবিলে যাবতীয় খাবার দেখেই উশখুশ করতে লাগলেন। পরমানন্দে ডাল নিতে নিতে দীপাকে উপদেশ দিলেন, শোনো, কারো রে পেট ভরা খাওয়াইতে ইচ্ছা করলে তিনটা পদ রাঁধবা। সবজী ডাল আর একটা মাছ। বড় জোর একপদ মাংস। বাকীগুলা হইলো অতিথিরা খাইতে না দেয়ার ফাঁদ।
চমৎকার একটা সম্পর্ক আমাদের। কবি, গদ্যশিল্পী দেশবরেণ্য মানুষ তিনি। কিন্তু আমার সমস্যা যাদের আমি ভালোবাসি শ্রদ্ধা করি তাদের স্খলন মানতে পারি না। দলান্ধ কেন হবেন তিনি? ইতিহাস যাঁর কবিতা তাঁর ছায়ায় সবাই শীতল হোক এই আশায় লেখালেখি করেছিলাম বলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ইনবক্সে বকা দিয়েছেন আমায়। এই গালমন্দ অগ্রজের আশীর্বাদ ধরে নিয়েছি।
আমি কখনো ভুলিনি বালি দ্বীপ ভ্রমণে যাবার পরপর তিনিই আমায় বলেছিলেন, সেখানকার সমুদ্রতটে বসে কোন কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভুলিনি পরেরবার দেশে গেলে অস্ট্রেলিয়ান আম নিয়ে যাবার শিশুসুলভ আবদার।
প্রতিকূলতায় অসাধারণ তিনি। দুঃসময়ে কবিতার তলোয়ার চকচকে হয়ে ওঠে তাঁর। তাঁর নিজের কথায়, ভালোবাসা অর্থ ও পুরষ্কার আদায় করে নিতে হয়। তিনি তা নেন এবং নিতে জানেন।
সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা
বেদনার জলাভূমি
সংসার মানে সংসার ভাঙা
সংসার মানে তুমি।
যে কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর কবিতা আমার নিত্যসঙ্গী। প্রেমে বিরহে আনন্দে বেদনায় তাঁর কবিতায় ফিরে যাই, ফিরে যাবো বারবার। তাঁর সেই কবিতার মতো:
মানুষ। মানুষকে ডাকছে, সেই কবে থেকে ডাকছে,
ডাকবে, ডাকতেই হবে, এটাই মানুষের স্বভাব।
মানুষ কি মানুষকে না ডেকে পারে? পারে না।
একদিন তুমিও আমাকে ডাকবে।