নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধে এক আলোচিত নাম শেখ ফজলুল হক মনি। চতুর্মুখী প্রতিভাবান এই যুবনেতা গত শতকের ষাটের দশকে একদিকে যেমন তুখোড় ছাত্রনেতা অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানও। পাশাপাশি একাধারে একজন সাংবাদিক, লেখক ও বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ধারক। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং রাজনৈতিক অনুসারী।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এ দেশে যুব রাজনীতির সূচনা করেন। তিনি যুবলীগের প্রথম চেয়ারম্যান। আজ যুব রাজনীতির আইকন এ নেতার জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্ম নেয় শেখ ফজলুল হক মনি। তার বাবা শেখ নূরুল হক বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি ও মা বঙ্গবন্ধুর বড় বোন আছিয়া খাতুন।
যুব রাজনীতির সঙ্গে লাখো যুবক যুক্ত থাকলেও শেখ মনির সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি না। মুক্তিযুদ্ধে গঠিত মুজিব বাহিনীর বিমান বাহিনী গঠনের মূল চিন্তাধারা ছিল যে মানুষটির তিনি হলেন শেখ মনি। এছাড়া ষাটের দশক থেকেই সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। এ জন্য ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুজিব বাহিনী গঠনের ধারণার উন্মেষ ঘটে। সেই নিউক্লিয়াসের প্রাণপুরুষ শেখ মনি।
কিন্তু বয়সের কারণে তাকে দেখার ভাগ্যে হয়নি। যুব রাজনীতির এ প্রতিষ্ঠাতার সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়, বর্তমানে ইন্টারনেট এর কল্যাণে কিছুটা জানতে পেরে আরো আগ্রহ তৈরি হয় মনে এবং আশ্চর্য হই, অভিভূত হই, একজন মানুষ কিভাবে এত গুণাবলীর অধিকারী হয় কি করে? মনে মনে খুঁজতে থাকি তার সম-সাময়িক রাজনীতিক এখন জীবিত আছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য, আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রেজাউর রহমান স্যার যিনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করেন।
স্যারকে মনি ভাইয়ের কথা জানতে চাইলে জানতে পারি, স্যার ছিল মনি ভাইয়ের একান্ত সহচর, যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য এবং পরে প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম সদস্য। স্যার বলেন, মনি ভাই ছিল এক কথায় জিনিয়াস। বঙ্গবন্ধু মনি ভাইয়ের মেধা মনন সাহসিকতা দেখেই তার আপন ভাগ্নেকে তার সাথে রাজনীতিতে এনেছিলেন।
রেজা স্যার বলেন, ঘাতকরা ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর আগে কেন মনি ভাইকে হত্যা করেছিল তা জানো? আমি মাথা ঝুঁকিয়ে না বলি। স্যার বলেন, ‘চিন্তা করে দেখো উত্তর পাবে। তিনি বলেন, মনি ভাইকে নিয়ে একটি স্মারক গ্রন্থ বানানো হবে। স্মারক গ্রন্থটি হলে বর্তমান সমাজ মনি ভাইয়ের সম্পর্কে আরো জানতে পারবে।’
আমি বাংলাদেশের যুব রাজনীতির পথিকৃৎ কে নিয়ে লিখার সাহস করছি আমার মানসিক শক্তি দিয়ে, কিন্তু যত গভীরে যাচ্ছি ভয় ও পাচ্ছি আবার এমন একজন গুণীজন সম্পর্কে লিখতে উত্তেজনাও অনুভব করছি! মনি ভাইয়ের কোথা হতে শুরু করবো তা বুঝতে অনেক সময় লাগলো তারপর এই ভেবে শুরু করলাম অসাধারণ মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনী, ইতিহাস, কাহিনী যেভাবেই লিখি তা মানুষ পড়বেই। কারণ মানুষকে লিখছে সেটার কথা ভুলে যাবে যখন সে পড়বে যে এটা একজন বহু প্রতিভাধর, বহুগুণ সম্পন্ন, একজন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন শেখ মনি এবং তার স্ত্রী আরজু মনিকেও হত্যা করা হয়েছিল। শেখ মনি দম্পতি রেখে গেছেন দুই পুত্র সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ এবং শেখ ফজলে নূর তাপস। রক্তে তাদের রাজনীতি। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আবার রক্তের উত্তরাধিকারই এখন উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এই যুব সংগঠনের নেতৃত্বে।
ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা শেখ ফজলে শামস পরশ এখন সংগঠনটির নেতৃত্বে। দায়িত্ব পাওয়ার পরেই অতীতের ‘কলঙ্ক’ ঘুচিয়ে ইতিবাচকতার পথে যুবলীগকে এগিয়ে নেয়ার গুরু দায়িত্ব নতুন নেতৃত্বের কাঁধে। পরশের নেতৃত্বে করোনা, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোকে সেই পরীক্ষায় প্রশংসা কুড়িয়েছে সংগঠনটি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দেখিয়েছেন মুনশিয়ানা। এখন নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলার সময় তাদের। পাথেয় হিসেবে সঙ্গে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ ফজলুল হক মনির আদর্শ। এই পথ ধরেই এগিয়ে যাব বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। শেখ মনির জন্মদিনের যুবলীগের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে বড় চাওয়া আর কি হতে পারে।
শেখ ফজলুল হক মনি:
১৯৬০-১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি মামলায় জয়লাভ করে ডিগ্রি ফিরে পান। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন তার রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক, লেখক ও বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ধারক। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ অগাস্ট তিনি সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তার সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস প্রকাশিত হয়। তার রচিত গল্পের সংকলন বৃত্ত ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, সম্প্রতি সংকলনটি আবারও প্রকাশিত হয়েছে ‘গীতারায়’ নামে। এ সংকলনের ‘অবাঞ্ছিত’ গল্পটি নিয়ে টেলিফিল্মও হয়েছে। শিশু-কিশোরদের সংগঠন শাপলা কুঁড়ির আসরের তিনি প্রতিষ্ঠাতা।