ড. মোহীত উল আলম: সোলস। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে অনন্য একটি নাম, ১৯৭২ সালে যেটির যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। গত ২৬ মে সোলসের সদস্য, ড্রামার সুব্রত বড়ূয়া রনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এখন যে সোলস ব্যান্ড দেশব্যাপী বিখ্যাত হয়েছে এটির গোড়াপত্তন কীভাবে হয়েছিল তার বর্ণনা দেওয়ার জন্য এ লেখা। আবার আমি সোলস ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সাজেদ উল আলমের পিঠাপিঠি আপন বড় ভাই। তাই সোলসের শুরুর দিনগুলো আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। এই রচনায় আমি সাজেদকে ‘সে’ করে এবং তার সহযোগী সংগীত জগতের বন্ধুদেরও ‘সে’ করে সম্বোধন করেছি, যেহেতু সে সময়ের আলোকে ওরা সবাই বয়সে আমার ছোট ও স্নেহধন্য ছিল।
সাজেদ উল আলম ১৯৭১-এর ২০ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরত আসে। তখন তার বয়স ১৫ বছরের সামান্য বেশি। সাজেদ চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিল। কিন্তু পরিবারের সংগীতময় আবহাওয়ায় বড় হওয়াতে ও ছোটবেলা থেকেই হারমোনিয়াম, তবলা, বেঞ্জো বাজাতে সড়গড় ছিল এবং কণ্ঠও দিত। মুক্তিযুদ্ধের আগে সাজেদ সে সময়ে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রবাল ও ঊমা ঘোষ ভাইবোন ছিলেন, যাদের কাছে সে যেত। আরেকজন ছিলেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রাজিয়া শাহিদ, যার সঙ্গেও সাজেদ গান-বাজনা করত। দেওয়ান বাজারস্থ মেজবাহউদ্দিন জঙ্গী চৌধুরী ‘সূচনা’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন চালাতেন। তিনি সাজেদের তালতো ভাই ছিলেন। তিনি একদিন সাজেদকে দায়িত্ব দিলেন সিরাজ- উদ-দৌলা রোডের গুল-এজার বালিকা বিদ্যালয়ে একটি বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য। সাজেদ সেটি খুব বড়ভাবে করল। যুদ্ধ থেকে সাজেদ যেদিন (২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১) তার পিত্রালয় কাজীর দেউড়ির ২ নম্বর গলির বাসায় ফিরে আসে সেদিন তার সঙ্গে কয়েকজন ভারতীয় সেনাও ছিল। ওরা একত্রে ধূমঘাট ভাঙা ব্রিজ দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। সাজেদের একটি অপূর্ব গুণ হলো, সে খুব তাড়াতাড়ি বিদেশিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে পারত। এই ভারতীয় সেনাগুলো সাজেদ এবং আমার ভাতিজা সাংবাদিক সায়ফুল আলমের (প্রয়াত) জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ উল আলমকে (প্রয়াত) চট্টগ্রাম ক্লাবে থার্টি ফার্স্ট উৎসবে আসতে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে সাজেদ তখন চট্টগ্রামের নামকরা ব্যান্ড নুয়েল মেন্ডিজের দল ‘লাইটনিং’-এর পরিবেশনা দেখে মুগ্ধ হয়, এবং তার মাথায় একটা ইনস্ট্রুমেন্টাল ব্যান্ড করার স্বপ্ন ঢোকে।
আনন্দময় সময়। উপরে সাজেদ উল আলম, মাঝে আহমেদ নেওয়াজ, নিচে সুব্রত বড়ূয়া রনি এবং বামে নকীব খান ও ডানে তপন চৌধুরী-সংগৃহীত
সাজেদের স্কুলজীবনের বন্ধু ও সংগীতপিপাসু হওয়ার কারণে সুব্রত বড়ুয়া রনির সঙ্গে সাজেদের সখ্য হয়, যেমন হয় সাজেদের সঙ্গে মমতাজুর রহমান লুলু, রুডি আর লরেঞ্জোর। এই সময় ১৯৭২ সালে, সাজেদ দল গঠন করার চিন্তা বাস্তবায়ন করে। দলের নাম ঠিক করার জন্য আমার বাবা সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের কাছে সে যায়। বাবা নাম ঠিক করে দেন ‘সুরেলা’। ‘সুরেলা’র লাইনআপে ছিল সাজেদ (লিড গিটার), সুব্রত বড়ুয়া রনি (কঙ্গোড্রাম জাতীয় বাদ্য), মোমতাজুর রহমান দুলু (একর্ডিয়ন), আমার চাচাতো ভাই তৌহিদুল আলম (সে বঙ্গো বাজাতো), আমাদের ভাগ্নী সেলিনা বেবি (গাইয়ে) এবং আমার ভাবি নার্গিস উল আলম (প্রয়াত সাংবাদিক মঈনুল আলমের স্ত্রী) সেতার বাজাতেন। আরও আসতেন পূর্বকোণের প্রয়াত সম্পাদক তসলিমউদ্দিন চৌধুরী, স্থপতিবিদ যিনি বাজাতেন গিটার, এবং তার বাসায় একটা পিয়ানো ছিল, সেটাও সাজেদ বাজাতো। সুরেলা’র প্রথম সফল অনুষ্ঠান হয় চট্টগ্রাম ক্লাবে ১৯৭২ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে। তাদের গাওয়া ‘দম মারো দম’ ও ইংরেজি গান ‘কাম সেপ্টেম্বর’ খুব সাড়া জাগায়। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে রুডি এবং লরেঞ্জো নামক দু’জন বাঙালি খ্রিষ্টান যুবক দলে যোগ দেয়। এদের নিয়ে আসে রনি। কারণ ওদের বাবা আর রনির বাবা একই ব্যাংকে চাকরি করতেন। তখন ঠিক হয় সবাই গিটার বাজাবে এবং ভোকালিস্ট হিসেবেও থাকবে। সাজেদ বাজাতো লিড গিটার আর ছিল ভোকালিস্ট, রুডি বেইজ গিটার আর ভোকালিস্ট এবং লরেঞ্জো রিদম গিটার আর ভোকালিস্ট। রনি থাকত কংগায়। ‘সুরেলা’ জনপ্রিয় হতে থাকলেও সাজেদের মনে চিন্তা আসে দলটিকে আরও আধুনিকায়ন করতে। কারণ রুডি আর লরেঞ্জা দু’জনই ভালো ইংরেজি গান গাইত। তখন ইংল্যান্ড থেকে দীর্ঘদিন প্রবাসজীবন কাটিয়ে সিলেটের লোক ওদুদ ইসলাম আমার জেঠাতো ভাই আনোয়ারুল আলমের সঙ্গে বন্ধুতার সূত্র ধরে একদিন কাজীর দেউড়িতে ‘সুরেলা’র মহড়া দেখতে আসেন। তিনি উৎসাহিত হয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে সাজেদদের জন্য একটি গিটার ও বারাকাস (ঝুনঝুনি টাইপের বাদ্যযন্ত্র) নিয়ে আসেন। তখন তিনি বাংলাদেশে কিছু টাকা লগ্নি করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় মঈন ভাই তাকে বললেন, তিনি যেহেতু ব্যান্ডসংগীতে উৎসাহী, তিনি সাজেদদের ‘সুরেলা’তে টাকা পুঁজি করতে পারেন। তখন তিনি সাজেদকে ২০ হাজার টাকা দেন। ওই টাকা দিয়ে সাজেদ কলকাতা থেকে একটি ভারতীয় ড্রাম সেট বা পারকিশন, একটি বেইজ গিটার, একটি লিড গিটার এবং একটি অ্যাম্পলিফায়ার কিনিয়ে আনে। ওদুদ সাহেব দীর্ঘদিন সোলসের ম্যানেজার ছিলেন। পার্টির সঙ্গে টাকা-পয়সার লেনদেন তিনিই করতেন। কিন্তু তিনি খুব সোজা গোছের লোক ছিলেন বলে মাঝে মধ্যে পাওনা নিয়ে গণ্ডগোল বেধে যেত। অনেক সময় সাজেদকে মুক্তিযোদ্ধার তেজ দিয়ে এই সব পার্টিকে শায়েস্তা করতে দেখেছি। আর নতুন কেনা বাজনা আর পুরোনো সবগুলোই রক্ষিত থাকত আমাদের বাসায় সাজেদের রুমে, আর মহড়াও হতো ওইখানে। তখন সাজেদ ঠিক করে ‘সুরেলা’ নাম বদলে ‘দ্য সোলস’ রাখবে। ‘দ্য সোলস’ নামটি ঠিক করে দেয় আমাদের ভাগ্নে এখন কানাডা প্রবাসী স্থপতিবিদ ফরিয়াদুল ইসলাম চৌধুরী।
মঈন ভাই (প্রয়াত সাংবাদিক মঈনুল আলম) আমাদের দোতলায় থাকতেন। তিনি বললেন, ‘দ্য সোলস’ নয়, শুধু ‘সোলস’ দাও। সেই থেকে ‘সোলস’ গঠিত হয়, ১৯৭৪ সালে একান্তই সাজেদের উদ্যোগে। তখন দলে যোগ দেয় নকীব, তপন, তাজুল ইমাম এবং আরও কয়েকজন। সোলসের লাইনআপটা ছিল এ রকম : সাজেদ, রনি, লরেঞ্জো, লুলু, তপন, নকীব, শাহেদ, রৌফ নামক একজন রোহিঙ্গা বর্মী গায়ক, আর মাঝে মধ্যে তসলিম। আর পরিবেশনার মধ্যে প্রথমে রুডি, লরেঞ্জো ইংরেজি গান পরিবেশন করত, তারপর পরিবেশিত হতো বাংলা গান কিশোর কুমারের কিংবা আর কারও। লোকগীতিও গাওয়া হতো, যেমন ‘মন আমার দেহ ঘড়ি, সন্ধান করি’। নেওয়াজও যোগ দেয় ওই সময়ে। নেওয়াজ গান না গাইলেও, সোলসের প্রচারপত্র ও প্রচারণার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা সে পালন করত। একসময় সোলসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন চট্টগ্রামের বিখ্যাত লোকগীতি গায়ক শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব আর শেফালী ঘোষ। শেফালী ঘোষ আমার আম্মার নিকট থেকে চাটগাঁইয়া পুঁথি ও শ্নোক সংগ্রহ করতেন। সোলসের গানের মধ্যে ‘মনে করো’, ‘তোকে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ নকীবের গলায় খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাজেদ বরাবরই লিড গিটার বাজালেও মাঝে মধ্যে বারকাস বাজিয়ে কণ্ঠ দিত। আর রনি বসত ড্রাম সেটে। তখন সোলসের একেকটা অনুষ্ঠান দেখতে দর্শকদের ঢেউ পড়ে যেত। সোলস এই সময়ে, ১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার অনুষ্ঠান করে।
১৯৯২ সালে ২০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে সোলস ব্যান্ডের সদস্যরা- সংগৃহীত
সোলসের মহড়া চলত আমাদের কাজীর দেউড়ির বাসায় বছরের পর বছর, সে ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত, সাজেদ দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। সেকি আওয়াজ, ড্রামের আর গিটারের। কান ঝালাপালা। পাড়া-প্রতিবেশীরা কতবার যে আমার বাবাকে নালিশ করতে আসতেন। আর আমি সাজেদের পিঠাপিঠি আপন বড় ভাই হওয়াতে এবং গান-বাজনা না পারলেও গান-বাজনার প্রতি ঝোঁক থাকাতে ওদের মহড়ায় উপস্থিত থাকতাম। তখন মঈনদার কাছে তার বন্ধু সাংবাদিক ইংরেজি পত্রিকা ‘পিপলস ভিউ’ পত্রিকার সম্পাদক এপিপির নূরুল ইসলাম সাহেব প্রায় আসতেন। আমাদের কাজীর দেউড়ির বাসার আকার ছিল ইংরেজি অক্ষর এল শেইপের। সাজেদের কামরা ছিল একেবারে পূর্বদিকে, আর আমার কামরা ছিল একবারে পশ্চিম-উত্তর দিকে। বাসার গেট ছিল দুটো। তখন আমার অনার্স ফাইনাল চলছিল। ১৯৭৫ সালে। নুরুল ইসলাম সাহেব মঈনদাকে বলতেন, ‘অ মঈন, কী ব্যাপার তোমার এক ভাই দেখি বাজনা বাজিয়ে ছাদ উড়িয়ে দিচ্ছে, আর আরেক ভাই নিবিষ্ট মনে পড়ছে!’ সে যাই হোক, সাজেদদের মহড়ায় আমি উপস্থিত থাকতাম। আমি এখনও স্মরণ থেকে বলতে পারি তাজুল একটি গান খুব গাইত ‘দুঃখ সুখের দুইটি ধারা’, আর তপন গাইত গাল প্রচণ্ড হাঁ করে, দেখতে আমার মজাই লাগত। তখন তার খুব অল্প বয়স ছিল। তবে তার গলায় খুব সুর ছিল। আর রউফ লিড ভোকালিস্ট ছিল অনেকদিন। মাঝে মধ্যে লুলুদের মোমিন রোডের বাসায়ও রিহার্সেল হতো।
সাজেদদের মহড়ার সময় উপস্থিত থাকত রেগুলার বেসিসে স্থপতি তসলিম চৌধুরী (এখন প্রয়াত), ফরিয়াদ আর স্বপন সরকার (এখন আমেরিকা প্রবাসী)। প্রতিবেশী হিসেবে মান্নান ভাই (আব্দুল মান্নান, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান) আর তার ভাই আলেপ আলীম মাঝে মধ্যে আসতেন। আর থাকত রণজিৎ বিশ্বাস, (প্রয়াত সিনিয়র সচিব এবং ক্রীড়া লেখক) যার সোলসের জীবন কাহিনির ওপর একটা লেখাও আছে জানি। এই সোলসের যুবক দলকে নিয়মিত আমার বৃদ্ধা মা লাঞ্চ, ডিনার খাইয়েছেন দিনের পর দিন। ‘সোলস’ ১৯৭৬ সালে সম্ভবত দেশের সেরা ব্যান্ড বিবেচিত হয়। সাজেদরা প্রতি রোববার বাজাত আগ্রাবাদ হোটেলে।
আরও একটি যোগাযোগ এখানে হয়। তখন ১৯৭২-৭৩ সালে আমার চতুর্থ ভাই শিল্পী সবিহ উল আলম চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পান। এটি পরে চবির অধীনে আর্ট ইনস্টিটিউট হয়। আর সাজেদ, তাজুল, রনি এবং আরও কেউ কেউ এই আর্ট কলেজের বিভিন্ন ব্যাচের ছাত্র ছিল।
লেখক: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম