দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন মনোনয়ন পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত পাবনাবাসী। এ খবর তার জন্মস্থান পাবনায় পৌঁছালে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। আনন্দ মিছিল হয়েছে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরএম একাডেমিতেও।
ব্যক্তি জীবনে সবার কাছে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও মানবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত সাহাবুদ্দিন। ছাত্র রাজনীতিতে থাকাবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে নেতা বানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাকে খুব ভালোবাসতেন।
পাবনার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে রয়েছে তার সখ্যতা। এ ছাড়া পাবনার রাজনীতিতে রয়েছে তার অগ্রণী ভূমিকা। সরকারি চাকরি জীবনেও রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তাই রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন পাওয়ায় তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সবার মাঝে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।
রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন পাওয়ার খবর পেয়ে রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জেলা আওয়ামীলীগ কার্যালয় থেকে আনন্দ মিছিল বের করেন দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে দলীয় কার্যালয়ে ফিরে শেষ হয়। পরে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
অন্যদিকে, দুপুর ২টার দিকে আনন্দ মিছিল করেন সাহাবুদ্দিনের কৈশরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরএম একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অধ্যক্ষ ও সভাপতির নেতৃত্বে আনন্দ মিছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
তার সম্পর্কে জানতে চাইলে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল রহিম লাল বলেন, ‘সাহাবুদ্দিন খুবই ভালো, সৎ ও পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ। তিনি অনেক দক্ষ ও মেধা সম্পন্ন মানুষ। তার রাজনৈতিক জীবনেও অনেক ইতিহাস রয়েছে। তিনি রাজনীতি করতে গিয়ে জেলও খেটেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। সাহাবুদ্দিন, রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবী ইসলাম, আব্দুর রহিম পাকন, ফজলুল হক মন্টু, আব্দুল হামিদ মাস্টার আমরা সবাই একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। তখন দেখেছি, কতটা ন্যায়পরায়ন তিনি। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই, তিনি একজন সঠিক মানুষকে রাষ্ট্রপতি পদে বেছে নিয়েছেন।’
জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল হামিদ মাস্টার বলেন, ‘আমরা কাছ থেকে দেখেছি, মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শের সৈনিক। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা ছাড়া তার জীবনে কিছু নেই। সবসময় তিনি এই পরিবারের কথাই বলেন। বঙ্গবন্ধুই তাকে নেতা বানিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধু তাকে ভালোবাসতেন। আমরা খুশি, তিনি একজন সুযোগ্য মানুষ।’
পাবনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এবিএম ফজলুর রহমান বলেন, ‘মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ১৯৭৫ সালে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন প্রেস ক্লাবের সদস্য পদ লাভ করেন। প্রেস ক্লাবের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকদের তিনি ভালোবাসেন, প্রেস ক্লাবের সদস্য সাংবাদিকরাও তাকে ভালোবাসেন। এজন্য এখন পর্যন্ত তিনি এই প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য। তিনি প্রেস ক্লাবের উন্নয়নে সবসময় পাশে থেকেছেন। প্রেস ক্লাবের কল্যাণ তহবিল তার পরামর্শে ও সহযোগিতায় চালু হয়েছে। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত তাকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করায়। কৃতজ্ঞতা প্রধানমন্ত্রীকে।’
মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পাবনার বাসভবনের পাশে বসবাসকারী প্রতিবেশি বাচ্চু প্রামাণিক বলেন, ‘তিনি আমার প্রতিবেশী। এখানেই তার বাড়ি। ঢাকা থেকে পাবনায় আসলে তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, খোঁজখবর নেন। কারো কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলো সমাধান করেন। তিনি অত্যন্ত ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী একজন মানুষ। তিনি রাষ্ট্রপতি মনোনীত হওয়ায় খুব খুশি আমরা।’
একই এলাকার পাশে বসবাসকারী মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের ছোট বোন ফারজানা মহিউদ্দিন বলেন, ‘পরিবারের মধ্যে তিনি সবার বড়। যেকারণে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো পরিবারকে তিনি আগলে রাখেন। তার মতো এত সুন্দর মনের মানুষ আর হয় না। ভাই হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে তিনি তুলনাহীন। তিনি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের খোঁজখবর রাখেন সবসময়। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, উৎফুল্ল আমার ভাই আজ এত বড় আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অশেষ কৃতজ্ঞতা।’
মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের স্মৃতি বিজরিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাধানগর মজুমদার একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আফজাল হোসেন বলেন, ‘সাহাবুদ্দিন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কৃতী শিক্ষার্থী ছিলেন। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন পাওয়ায় আজ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গৌরবান্বিত হলো।’
স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সোহেল হাসান শাহীন বলেন, ‘একজন যোগ্য মানুষকে প্রধানমন্ত্রী যোগ্য পদে অধিষ্ঠিত করলেন। এ যুগে সাহাবুদ্দিনের মতো মানুষ পাওয়া সত্যিই কঠিন। আমাদের প্রত্যাশা তার মাধ্যমে দেশ আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা যে তিনি জহুরীর মতো হিরা চিনতে ভুল করেননি।’
সাংবাদিক কলামিস্ট হাবিবুর রহমান স্বপন বলেন, ‘পাবনার গণমানুষের সঙ্গে সাহাবুদ্দিনের যোগাযোগ সবসময় আছে সেই ছাত্রজীবন থেকে। ছাত্রনেতা হিসেবেও ছিলেন জনপ্রিয়। মৃদু ভাষী, ধীর স্থির মানুষ। তিনি কখনও কাউকে কটু কথা বলেছেন বলে জানা নেই। তিনি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সত্যি একজন সেরা ও যোগ্য মানুষ।’
মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের জীবনী: তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে ও পরিবারের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, পাবনা শহরের শিবরামপুরের লক্ষীসাগর এলাকার বাড়িতে ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। বাবা শরফুদ্দিন আনসারী ছিলেন ব্যবসায়ী। আর মা খায়রুন নেসা ছিলেন গৃহিণী। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে সবার বড় সাহাবুদ্দিন। ব্যক্তিজীবের তিনি এক পুত্র সন্তানের জনক। ছেলের নাম আদনান রনি। ঢাকায় বসবাস করেন।
১৯৬৬ সালে পাবনা শহরের রাধানগর মজুমদার একাডেমি থেকে মাধ্যমিক পাস করেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। এরপর সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি ও বিএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে এমএসসি এবং পাবনার শহীদ আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে তিনি পাবনা জেলা কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মনোনীত হন। ওই বছর ১৫ আগস্টের পর সামরিক আইন বলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরবর্তীকালে তিনি কয়েক বছর সাংবাদিকতা করেছেন দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ভারতে প্রশিক্ষিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮২ সালে বিসিএস পরীক্ষার পরপরই সহকারী জজ হিসেবে শুরু করেন চাকরি জীবন। জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসর নেন তিনি।
২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাবনা প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য। সাংবাদিকদের কল্যাণের জন্য তার পরামর্শ ও সহযোগিতায় প্রেস ক্লাবের কল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম শুরু হয়। সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।