পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২২ মাসে টেকনাফে ১৪৪টি ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ২০৪ জন মারা গেছেন। তাদের অর্ধেকের বেশি লাশ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভে। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। যাকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়া হতো ১০-১২ দিন তাকে থানা হাজতে রাখা হতো। আবার মাসের পর মাস থানা হাজতে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। এই সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ না দেয়ার আশ্বাসে ওই ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে আদায় করা হতো লাখ লাখ টাকা। তবে শেষরক্ষা হয়নি অনেকের।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, টাকার নেশায় মরিয়া ওসি প্রদীপের মতো এমন পুলিশ কর্মকর্তা জীবনেও দেখিনি। ‘ক্রসফায়ারের’ নামে মানুষ খুন করা ছিল তার নেশা। টেকনাফ থেকে ওসি প্রদীপ ২০০ কোটি টাকার অধিক নিয়েছেন। টেকনাফ থানায় ওসি প্রদীপের ডানে-বামে থাকা পাঁচ-ছয়জন ও টেকনাফের স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই ওসি প্রদীপের ‘ক্রসফায়ার’ ও চাঁদাবাজির রোমহর্ষক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
টেকনাফের গুদারবিল এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু ছৈয়দ এবং সাবরাংয়ের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আছারবনিয়ার ইউপি সদস্য শরিফ প্রকাশ শরিফ বলি ছিলেন ওসি প্রদীপের অপকর্মের সহযোগী। প্রদীপের টাকায় মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে গরু এনে টেকনাফ হয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি করা হতো। ভাগের টাকা চট্টগ্রামে বুঝে নিতেন প্রদীপের লোকজন। অধিকাংশ ‘ক্রসফায়ারের’ চাঁদাবাজির টাকাও এই দুই মেম্বারের হাতে যেতো। অন্য টাকা নিতেন প্রদীপের বডিগার্ড কনস্টেবল সাগর। এভাবে ‘বর্ণচোরার’ মতো চলেছে প্রদীপের ‘ক্রসফায়ার’ বাণিজ্য।
‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে আটক ব্যক্তির পরিবার থেকে লুটে নেয়া হতো স্বর্ণালঙ্কার। তা বিক্রি করা হতো চট্টগ্রামের স্বর্ণ মহাজন সজল ধরের কাছে। তার কাছে যেত লুণ্ঠিত সব ধরনের স্বর্ণালঙ্কার। প্রদীপের টেকনাফে স্থানীয় সহযোগীর মাঝে অন্যতম হিসেবে নাম এসেছে টেকনাফ কমিউনিটি পুলিশের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নুরুল হোসাইনের। পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন তিনি।
২৭ জুলাই সেন্টমার্টিন থেকে আটক মাছ ব্যবসায়ী জুবায়েরকে ‘ক্রসফায়ার’ থেকে বাঁচানোর কথা বলে দুই দফায় ১০ লাখ টাকা নেন নুরুল হোসাইন ও আবদুল কাইয়ুম নামে দুই ব্যক্তি। এরপরও জুবায়ের ছাড়া পাননি। অবশেষে তাকে মামলার আসামি করেন ওসি প্রদীপ। মামলায় জড়ানোর পর টাকা ফেরত পেতে সহযোগিতা চেয়ে টেকনাফের ইউএনও এবং বিশেষ এক গোয়েন্দা শাখার কাছে লিখিত অভিযোগ
নিজের আওতাধীন এলাকা না হওয়া সত্ত্বেও গত ২৪ জুলাই রাতে উখিয়ার কুতুপালং থেকে ইউপি সদস্য মোলভী বখতিয়ারকে ধরে নিয়ে যান ওসি প্রদীপ। তার সঙ্গে নিয়ে যান রোহিঙ্গা তাহের নামে আরেকজনকে। রাতে এসে বখতিয়ার মেম্বারের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৫০ লাখ টাকা নিয়ে যান ওসি প্রদীপ। পরে ‘ক্রসফায়ারে’ না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার ছেলে হেলাল থেকে নেয়া হয় আরও ২৭ লাখ টাকা। জমি-মার্কেট বন্ধক রেখে ৮৭ লাখ টাকা দেয়া হলেও পরদিন দুইজনকে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করেন ওসি প্রদীপ। এ ঘটনায় করা মামলায় বখতিয়ারের ঘর থেকে নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধারের গল্প সাজানো হয়। এসব তথ্য একটি বিশেষ সংস্থার কাছে দেয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন মৌলভী বখতিয়ারের স্ত্রী।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ওসি প্রদীপের ৫-৬ জন সহযোগী রয়েছেন। তাদের জন্য রাখা রাখা ছিল কয়েকটি মাইক্রোবাস। এসব গাড়ি নিয়ে একেকজন রাতে বেরিয়ে পড়েন। স্থানীয় লোকজনকে আটক করে রাতে থানার তিনতলার টর্চার সেলে নিয়ে যেতেন। টর্চার সেলে দাবিকৃত টাকা না পেলে তার ভাগ্যে নেমে আসত মেরিন ড্রাইভের সাজা। সাজানো হতো ‘ক্রসফায়ারের’ নাটক। পরে একেকটি মামলায় ২০-২৫ জনকে আসামি করা হতো। এভাবে টেকনাফের মানুষকে জিম্মি করে রাখেন ওসি প্রদীপ। আটক ব্যক্তিকে থানায় এনে মারধর করে ইয়াবা, অস্ত্র ও গুলি দিয়ে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে বিভিন্ন জনের নাম বলাতেন ওসি প্রদীপ। সেই সঙ্গে টার্গেট করে টাকা আদায় ও ‘ক্রসফায়ারের’ নাটক সাজাতেন তিনি।
এমনও ঘটনা রয়েছে থানায় মামলা হয়েছে অথচ আসামি কিছুই জানেন না। পরে মামলায় আসামি হওয়ার কথা শুনে অনেকে অসুস্থ হন। কেউ কেউ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এসব ঘটনা কাউকে জানানোর সাহসও করেননি তারা।
ভুক্তভুগী সাবরাং কাটাবনিয়ার কামাল হোসন বলেন, গত বছরের ৭ জানুয়ারি টেকনাফ থানার এএসআই সজিব দত্ত আমার ভাই আবুল কালামকে আটক করে থানায় তিনদিন আটকে রাখেন। পরে আমার মা জরিনা খাতুন অনেক অনুরোধ করে এএসআই সজিব দত্তের সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকায় ছেড়ে দেয়ার চুক্তি করেন। মা নিজ হাতে সজিবকে পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকা দেন। ১০ জানুয়ারি সকালে আমার ভাইকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়া হয়। টাকা দেয়ার পরও রক্ষা পায়নি আমার ভাই। পরে এএসআই সজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিন লাখ টাকা ফেরত দেন। বাকি টাকা এখনও দেননি।
তিনি বলেন, আমার ভাই কালাম ‘ইয়াবার গডফাদার’ ছিল না, অথচ ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়ার পর তাকে গডফাদার বলা হলো। তার বিরুদ্ধে মাদকের কোনো মামলা ছিল না। হত্যার পর তার নামে মাদকের মামলার কথা বলা হলো। জমিজমা নিয়ে মারামারির মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। অথচ ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার পর বলা হলো মামলা আছে মাদকের। এসব মিথ্যা। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।
প্রদীপের সহযোগীদের হাতে টেকনাফের আওয়ামী লীগ নেতা হামজালাল মেম্বারও আটক হয়েছিলেন। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি তাকে আটক করে ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে ছয় লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। পরে তাকে তিন হাজার ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়।
একই ভাবে টেকনাফ সদরের পল্লান পাড়ার আবদুস শুক্কুর বিএকে আটক করে ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে চার লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর মুফতি জাফরের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, মিঠাপানির ছড়ার সরওয়ারের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা, ওমর হাকিম মেম্বারের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা, ছোট হাবির পাড়ার মহিউদ্দীনের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা, ইসলামাবাদের নেজাম থেকে দুই দফায় নয় লাখ টাকা, মিঠাপানির ছড়ার মো. তৈয়ুবের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা ও রাজার ছড়ার মৌলভী আব্দুল হামিদের কাছ থেকে দুই দফায় ১৫ লাখ টাকা নেন ওসি প্রদীপ।
দেন জুবায়েরের ভাই ইউনুস
শীলবনিয়া পাড়ার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর বাড়ি নির্মাণে বাধা দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা, মাঠপাড়ার মোহাম্মদ হোছন থেকে ৪০ লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর ফিরোজ মিয়ার কাছ থেকে চার লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর জামালের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর সৈয়দ মিয়ার থেকে পাঁচ লাখ টাকা, দক্ষিণ লেঙ্গুরবিলের এনামের কাজ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, সদর চেয়ারম্যান শাহজাহানের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা, সেন্ট মার্টিন পূর্বপাড়ার আজিমের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা, শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়ার ইসমাইলের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাবরাং মন্ডলপাড়ার এজাহার মিয়ার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, একই এলাকার জামালের কাছ থেকে চার লাখ টাকা, লেঙ্গুরবিলের ইউনুসের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা নেন ওসি প্রদীপ। টাকা নিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ না দিয়ে কমবেশি ইয়াবা দিয়ে আদালতে এদের চালান দেন তিনি।
টেকনাফ থানা পুলিশের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি তিনি।
শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক মেজর সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন ও নিরাপত্তা বিভাগ। একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।
বৃহস্পতিবার (০৬ আগস্ট) চট্টগ্রাম থেকে ওসি প্রদীপকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ সাত পুলিশ সদস্য কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। জামিন আবেদন নাকচ করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. হেলাল উদ্দিন।
সন্ধ্যায় কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. হেলাল উদ্দিনের আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন র্যাব-১৫ এর সেকেন্ড ইন কমান্ডার (টুআইসি) মেজর মেহেদী হাসান।
শুনানি শেষে ১, ২ ও ৩ নম্বর আসামির সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর ও মামলার অন্য চার আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন বিচারক। একই সঙ্গে পলাতক দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
বুধবার রাত ১০টায় টেকনাফ থানায় আদালতের নির্দেশে মেজর সিনহার বোনের করা হত্যা মামলাটি নথিভুক্ত হয়। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ টেকনাফের বিচারক তামান্না ফারহার আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া। পরে আদালত ৩০২/২০১ ও ৩৪ ধারায় করা ফৌজদারি আবেদন টেকনাফ থানাকে মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেন। এছাড়া বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার তদন্তভার কক্সবাজারের র্যাব-১৫ এর অধিনায়ককে দিতে সুপারিশ করা হয়।
সিনহার বোনের দায়ের করা মামলায় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকতকে প্রধান আসামি ও টেকনাফ থানার প্রত্যাহারকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে দ্বিতীয় আসামি করে আরও ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়।