আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে ,৭১-এর উত্তাল মার্চের প্রথম দিনে আগুন জ্বলেছিল সেই সময়ের ঢাকা স্টেডিয়ামে। সেটা পাকিস্তান ক্রিকেট র্বোড একাদশ আর আর্ন্তজাতিক একাদশের মধ্যেকার এক চারদিনের ম্যাচের চতুর্থদিনে। তবে কোন ক্রিকেটীয় ঘটনায় নয়। ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদেও নয়। তবে প্রতিবাদ। আর সেই প্রতিবাদ ছিল রাজনৈতিক প্রতিবাদ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেদিন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছিলেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। আর পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট সেটা করেছিলেন নির্বাচনে জয়ী বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। তার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠলো মুক্তিকামী বাঙালি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের নগরীতে রূপ নিলো ঢাকা। সেই শহরে ক্রিকেট ম্যাচ! তা কী করে হয়! গ্যালারির সামিয়ানা-বাউন্ডারি লাইনের রশিতে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন দেশপ্রেমী মানুষ। বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনে স্মরক হয়ে থাকলো ১ মার্চ ঢাকার ক্রিকেট মাঠও। পরেরটুকু ইতিহাস। বাঙালির স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ তার স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী উদযাপনের অপেক্ষায়।
কিন্তু বাঙালির ক্রিকেট স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটেছিল যে ঢাকা স্টেডিয়ামে, সেই গর্বের মিনারে আজ আর কোন ক্রিকেট ম্যাচ হয় না! বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ করা হলো অথচ চরম ঔদাসীন্য দেখানো হলো সেখানে ক্রিকেট আয়োজনে! অন্য সরকারগুলো রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধুতে ক্রিকেট আয়োজন না করতেই পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সেই ঔদাসীন্য দেখাচ্ছে যা রীতিমত বিস্ময়কর। বঙ্গবন্ধুর নামে মুজিব বর্ষে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করে সমকালকে খানিকটা প্রভাবিত করা যায়, কিন্তু তাতে বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কতোটা তুলে ধরার চেষ্টা থাকলো?
আসলে আমাদের ক্রিকেটচার্চায় দিনে দিনে দেশ ভাবনা কমে আসছে। তাই বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলার চেতনাটাও হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকের মনে হতে পারে, এই কঠিন পেশাদার যুগে ওসব রোমান্টিকতায় ভেজা কিছু বাঙালির মনের আবেগ। তাই বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাসের বিপ্লবী ঘটনাকেও ফিরে দেখতে চায় না। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে ফিরে দেখাটা জরুরি।
জয় বাংলা’ বাঙালির মুক্তির শ্লোগান। প্রাণের শ্লোগান। ’৭১-এ পাকিস্তান একাদশ এবং মিকি স্টুয়ার্টের আর্ন্তজাতিক একাদশের চারদিনের ম্যাচেও বাঙালির সেই প্রাণের শ্লোগান ছাপার অক্ষরে স্টিকার হয়ে এক ক্রিকেটারের ব্যাটে উঠে এসেছিল। তিনি রকিবুল হাসান। ব্যাটে জয় বাংলা স্টিকার লাগিয়ে আন্তর্জাতিক একাদশের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। ম্যাচের প্রথম দিন বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামালের পরামর্শে রকিবুলের ব্যাটে ঐ স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছিলেন তার বন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। জয় বাংলা স্টিকার লাগানোর সেই ব্যাট তো বাঙালির ক্রিকেট মুক্তির অন্যরকম স্মারক। কিন্তু তার কোন রেপলিকাও সংরক্ষণে রাখেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট র্বোড!
বাংলাদেশ ক্রিকেটে রকিবুল হাসান নামটা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে। তিনি আলোচিত, সমালোচিত তবে বিস্মৃত নন। তাকে উপেক্ষা করতে পারেন, তবে অবজ্ঞা করতে পারবেন না। তার ক্রিকেট মন-মনন –প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার কারণে তাকে আপনার স্বীকার করতেই হবে। তার টেস্ট ক্যারিয়ার হয়তো উৎসর্গিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, কিন্তু দেশের হয়ে তিনিই প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। ওয়ানডে ইতিহাসে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলের মুখোমুখিও হয়েছিলেন তিনি। ইমরান-ওয়ামিম-জাকির-কাদিরদের নিয়ে গড়া পাকিস্তানের সেই অ্যাটাকের বিপক্ষে হোক না লেখা তার নামের পাশে ৫ রান, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঐতিহাসিক মুহুর্ত থেকে রকিবুল হাসান নামকে তো মুছে ফেলা যাবে না।
তবে স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তীর আগে সেই রকিবুল হাসানকে নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এক পরিচালক, সাবেক অধিনায়ক যে কাণ্ড ঘটালেন সেটা মর্মবেদনার কারণ। তবে রকিবুল হাসানের ক্রিকেটীয় নির্যাস ঘোষিত হয় না তার মুখের কারণে। ব্যাট দিয়ে রকিবুল হাসান দেশের ক্রিকেটকে সম্মৃদ্ধ করতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু একটা প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট মশালটাতো তিনি এবং তার প্রজন্মের লোকরাই জ্বেলে রেখেছিলেন। পরম্পরার সেই মূল্যবোধটা আমাদের ক্রিকেট থেকে হারিয়ে গেছে।
একাত্তরে বাঙালির মুক্তির শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’, এই চার অক্ষরকে নিজের ব্যাটে সঙ্গী করে ক্রিকেট মাঠে নেমেছিলেন যিনি তার ঋণ খারিজ করে দিবেন কিভাবে আপনি? লোকটাকে আপনি অপছন্দ করতেই পারেন, কিন্তু তার সাহসের মিনারকে স্বীকার করার একটা দায়বদ্ধতা থেকেই যায় জাতি হিসেবে।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।