শ্যামনগর উপকূলের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র এক বছর আগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আবারও একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আগমনী বার্তায় শঙ্কিত স্থানীয় ব্যক্তিরা। বিশেষ করে সংস্কারের অভাবে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধের করুণ অবস্থা উপকূলবাসীকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে।
গত দুই দিনে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুরসহ কৈখালী এলাকা ঘুরে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা মিলেছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, বুলবুল ও আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া উপকূল রক্ষা বাঁধের বেশির ভাগ অংশ মজবুতভাবে বাঁধা হয়নি। বাঁধের অনেকাংশে টেকসইভাবে মেরামতকাজে হাত পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এমতাবস্থায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস যদি আবারও সুন্দরবন–সংলগ্ন এ উপকূলীয় জনপদে আঘাত হানে, তবে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ভরা পূর্ণিমার কারণে ওই সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় নদ-নদীতে জোয়ারের পানি তিন–চার ফুট বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকায় তাঁরা চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের ফিরোজ হোসেন বলছেন, আম্পানের পর একটা বছর কেটে গেলেও গাবুরাকে ঘিরে থাকা বাঁধের অনেক জায়গা এখনো সরু আলে পরিণত হয়েই আছে। এমন অবস্থায় ভরা পূর্ণিমায় যদি ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আছড়ে পড়ে, তবে সাগরে ভেসে যেতে হবে। সরু হয়ে যাওয়া ভাঙনমুখে থাকা বাঁধের গোড়ায় ব্যাগ ফেলে আপাতত স্থানীয় ব্যক্তিদের রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলেও তিনি জানান।
সুন্দরবনের সবচেয়ে কাছের জনবসতি গোলাখালী। সেখানকার বাসিন্দা আকিরুন বেগম বলেন, তিন পাশে নদী আর এক পাশে বনকে আশ্রয় করে তাঁদের বসতি। আম্পানের আঘাতে বাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা এলোমেলো হয়ে গেল। তিন-চার দিন আগে স্থানীয় ব্যক্তিরা বাঁধের ভাঙনকবলিত অংশ বেঁধেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবারের ঘূর্ণিঝড় ভরা জোয়ারের সময় আঘাত করলে সাগরের সঙ্গে মিশে যেতে হবে।
একই গ্রামের আসলাম হোসেন বলেন, ইয়াসের সম্ভাব্য আঘাতের সময় ২৬ মে হলে তখন নদীতে জোয়ারের পানি অনেক বৃদ্ধি পাবে। ওই মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে গোটা উপকূল সাগরের সঙ্গে একাকার হয়ে যাবে। আগেই বাড়িঘর ছেড়ে গিয়ে নিজেদের হয়তো বাঁচানো যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, বসতবাড়িসহ এত বছর ধরে গড়ে তোলা সহায়–সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে পড়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
আরও পড়ুনঃ
বুড়িগোয়ালীনির দুর্গাবাটি গ্রামের প্রভাষক পরীক্ষিত মণ্ডল ও নিলুৎপল মণ্ডল জানান, আম্পানের আঘাত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যে মাত্র দুই মাস আগে বাঁধ ভেঙে গোটা এলাকা প্লাবিত হয়। যার প্রভাবে ইতিমধ্যে গোটা এলাকাজুড়ে খাবারসহ ব্যবহার উপযোগী পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় নতুন করে ঘূর্ণিঝড় আঘাতের পূর্বঘোষণাতে এলাকাবাসীর মধ্যে নিদারুণ অসহায়ত্ব ভর করেছে।
জাতীয় মহিলা সংস্থার শ্যামনগর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহানা হামিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এলেই অনেক কথা হয়। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে ঝুঁকির মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষার বিষয়ে কার্যত কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুর্যোগের সময়ে তাঁরা বারবার উদ্বাস্তু হওয়ার শঙ্কায় ভোগে।
বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে ২৬ মে ভারত-বাংলাদেশের সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকা অতিক্রমের বার্তা দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে উপকূলীয় জনপদে কর্মরত পাউবো, বিদ্যুৎ ও সিপিপির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবায় যুক্ত সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকতে বলা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সাতক্ষীরা বিভাগ-১–এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, আম্পানের আঘাতের পর ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ ইতিমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা প্রায় ১২৫ কিলোমটির বাঁধের কোথাও আপাতত বড় ধরনের কোনো সমস্যা নেই। তবে অতিরিক্ত জোয়ারের পানি যেন ছাপিয়ে বাঁধের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য একাধিক দল দুর্বলতা খুঁজে বের করে সমাধানে কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছে, ২৫ মের আগেই গোটা শ্যামনগরকে ঘিরে বাঁধের দুর্বল স্থানে কাজ শেষ করে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দেওয়া যাবে।