সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি মডেল ধানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদের মৃত্যুর ৮ দিন পর তার পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করেন। সম্মেলনে রায়হানের মা সালমা বেগম আবারো পুত্র হত্যার বিচার দাবি করে বলেন,আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদেরকে আজও পুলিশ গ্রেফতার করতে না পারার বিষয়টি রহস্যজনক। তিনি বলেন, নিরপরাধ পুত্র হত্যার বিষয়টি আজ অনেকটাই স্পষ্ট। তারপরও পুলিশ অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টায় আছে। তিনি বলেন, এই হত্যা রহস্য উদঘাটনে আপনারা সজাগ থাকবেন। পরে ৬ দাবি পেশ সহ ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা করেন এলাকার মুরুব্বি শওকত হোসেন।
রবিবার বিকেলে নগরীর আখালিয়া নেহারিপাড়াস্থ গুলতেরা মঞ্জিলে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, রায়হান আহমদ হত্যায় জড়িতদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার না করা হলে পরিবার এবং এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে হরতাল ও সড়ক অবরোধসহ দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে। সংবাদ সম্মেলনে নিহত রায়হানের মা সালমা বেগমের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন রায়হানের মামাতো ভাই ও স্থানীয় মুরুব্বি শওকত।
দাবিগুলো হচ্ছে- ১. রায়হান হত্যাকাণ্ডে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি, ২. রায়হান হত্যায় জড়িত পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) আকবর ভূঁইয়াসহ দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার, ৩.পলাতক এসআই আকবর ভূঁইয়াকে গ্রেফতারে আইজিপির নির্দেশ,৪.পুলিশ কমিশনারের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য, ৫.নিহতের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন ও ৬. ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তার না করলে হরতাল-সড়ক অবরোধসহ বৃহত্তর আন্দোলন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান ও ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, ১০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ, ৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান, কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন, নারী কাউন্সিলর রেবেকা বেগম, সাবেক কাউন্সিলর জগদীশ দাশ ও রায়হানের সৎ বাবা হাবিবুল্লাহসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
গত রবিবার রায়হানকে ‘পুলিশি নির্যাতনে’ হত্যা করা হয় বলে পরিবারের দাবি। রায়হান নগরীর আখালিয়ার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। তার তিন মাসের এক মেয়ে রয়েছে। তিনি নগরীর রিকাবিবাজার স্টেডিয়াম মার্কেটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে কাজ করতেন।
রায়হানকে নির্যাতন করে হত্যার নেপথ্যে কি ছিল? এসআই আকবর গ্রেফতার না হওয়া আরেক রহস্য
এদিকে রায়হানের হত্যা মামলার প্রধান আসামি বন্দর পুলিশ ফাড়ির এসআই আকবর (বরাখাস্তকৃত) পলাতক রয়েছেন। ঘটনার ৮ দিন পরও আকবরকে পুলিশ খুজে না পাওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। বিভিন্ন সূত্র জানায়, রায়হান হত্যা পরিকল্পিত এবং রায়হান নাকি এসআই আকবরের পূর্ব পরিচিত। লেনদেন সম্পর্কিত কোনো ঘটনার জেরে এই অঘটন কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে অনেকেই বলেছেন।
সূত্রমতে, এসআই আকবরকে এখন রক্ষার জোর লবিং চলছে। তবে সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ রায়হানের পরিবারের সাথে দেখা করে বলেছেন, রায়হানের খুনিরা গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় না আসা পর্যন্ত তারা ঐ পরিবারের পাশে থাকবেন। এদিকে এসএমপি কমিশনার গোলাম কিবরিয়া গতকাল সন্ধ্যায় ইত্তেফাকে বলেন, মামলটি পিবিআই তদন্ত করছে। তবে এসআই আকবরকে গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
রায়হানের শরীরে এক শত এগারোটি আঘাত, ১৪টি গুরুতর
বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে মারা যাওয়া রায়হান আহমদের শরীরে একশত ১১টি আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। এর মধ্যে ১৪টি গুরুতর আঘাত ছিলো বলে উল্লেখ করা হয় এবং মৃত্যুর ২-৪ ঘণ্টা আগে নির্যাতন চালানো হয় বলে রিপোর্টে বলা হয়।
রায়হানের ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল আর বাম হাতের অনামিকার নখ উপড়ানো ছিল। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে তার মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ কারণ ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়ার পর বলা যাবে বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তার শরীরে চামড়ার নিচ থেকে প্রায় ২ লিটার রক্ত পাওয়া গেছে।
সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ রায়হান আহমদের মরদেহের দ্বিতীয় ময়না তদন্ত শেষে তদন্তের রিপোর্ট পিবিআই এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। রায়হান হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রীর দায়ের করা মামলার তদন্ত করছে পিবিআই।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে আনা হয়। পরে সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে ভর্তি করা হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান। রায়হানের মৃত্যুর ২ থেকে ৪ ঘণ্টা আগে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে ১২ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর এসআই আকবরসহ ৪ পুলিশকে বরখাস্ত ও ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১৩ অক্টোবর বিকেল থেকে আকবর পলাতক। গত বৃহস্পতিবার রায়হানের মরদেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত করে পিবিআই। পরে বিকালে আবার আখালিয়া নবাবী মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে রায়হানের মরদেহ ফের দাফন করা হয়।