আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
# ১৫ বছর গৃহযুদ্ধ সামলে ১২ দিনেই পতন আসাদ সাম্রাজ্যের
# সিরিয়ায় ‘নতুন যুগের সূচনা’ ঘোষণা বিদ্রোহীদের
# দামেস্কে রাস্তায়-রাস্তায় উল্লাস
বিদ্রোহীদের তড়িৎগতির আন্দোলনের মুখে সিরিয়ার সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ ও সিরিয়া ছেড়ে চলে গেছেন বাশার আল-আসাদ। তবে সিরিয়া ছাড়ার আগে নিজ গন্তব্য সম্পর্কে কাউকে কোনও তথ্য জানাননি তিনি।
রোববার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার বিষয়ে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘‘শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেছেন বাশার আল-আসাদ।’’
সিরিয়ার এই প্রেসিডেন্ট বর্তমানে কোথায় রয়েছেন, সেই বিষয়ে বিবৃতিতে কোনও তথ্য জানায়নি রাশিয়া। বিবৃতিতে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাশার আল-আসাদের দেশ ত্যাগের বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেয়নি রাশিয়া। তবে তিনি দেশ ছেড়েছেন।
সিরিয়ায় দীর্ঘ ১৫ বছরের গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে পারলেও, এবার মাত্র ১২ দিনে পতন ঘটল বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসনামলের। গেল ২৭ নভেম্বর আলেপ্পোতে প্রবেশের পর অপ্রতিরোধ্য গতিতে সিরিয়ার একের পর এক শহর নিয়ন্ত্রণে নিতে থাকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম।
বিশাল সেনাবহর নেই হায়াত তাহরির আল-শামের। তবুও আট বছর পর আচমকা হামলা শুরুর মাত্র ১২ দিনের মাথায় পতন ঘটলো আসাদ সরকারের।
গৃহযুদ্ধের শুরুতে ২০১১ সালে আসাদ সরকারের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিল রাশিয়া এবং ইরান। রাশিয়ার বিমান এবং হিজবুল্লাহর সেনাবহরের সাহায্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের পিছু হটাতে সাফল্য পেয়েছিল সরকার। ঘুরিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধের মোড়।
তবে, ইউক্রেন-রাশিয়া এবং ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের বদৌলতে এই বড় দুই মিত্র শক্তির সহযোগিতার অনুপস্থিতি বিপাকে ফেলে আসাদ সরকারকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সশস্ত্র বাহিনীর কার্যকারিতার অভাব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কম বেতন এবং অভিজ্ঞতার অভাব সিরিয়ার সেনাদের কার্যকারিতা কমিয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত এক ব্রিটিশ কর্নেলের মতে, স্বজনপ্রীতির পরিপ্রেক্ষিতে সেনাদের নিয়োগ দিতো আসাদ সরকার। তাই দক্ষ সেনার বরাবরই অভাব ছিল বাহিনীতে। রুশ সেনাদের কাঁধে ভর করেই আগে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করে আসছিলেন তারা।
এমনকি, সাধারণ সেনাদের উন্নতির জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হতো না বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে ২০২০ সালে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করার পর থেকে নেতিয়ে পড়েছিল সিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনী। তাই, আচমকা এই হামলার মুখে রুশ এবং হিজুল্লাহর সেনাদের সাহায্যের অভাবে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়ে।
এছাড়াও, ২০১৬ সালে বিদ্রোহীদের দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং ২০২০ সালের যুদ্ধবিরতি, সিরিয়ার প্রতি পরাশক্তিদের মনযোগ কমিয়ে এনেছে। এরমধ্যে, আসাদ সরকারের পরিকল্পনার অভাব এবং প্রশাসনের দুর্বলতা অনেক আগেই ভেতর থেকে ক্ষয় করে দিচ্ছিল আসাদ সরকারের গদি। তাই, আচমকা হামলার এই ধাক্কা সামলাতে পারেননি ২৪ বছর ক্ষমতায় থাকা বাশার আল-আসাদ।
এদিকে, বাশার আল আসাদের পতনের পর তুমুল আলোচনায় সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম। ১৯৮২ সালে সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এই গোষ্ঠীটির প্রতিষ্ঠাতা।
২০০৩ সালে সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদায় যোগ দিলেও পরবর্তীতে সেখান থেকে বের হয়ে আল-নুসরা ফ্রন্ট নামে গড়ে তোলেন আলাদা সশস্ত্র সংগঠন। ২০১৭ সালে বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ করে গঠন করেন হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএস নামের নতুন সংগঠন।
দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ার ইদলিব শাসন পরিচালনা করে আসলেও গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর শাসন ও বিরোধী মত দমনের অভিযোগ। জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদার সঙ্গেও রয়েছে সখ্যতা। তবে জোলানির দাবি সন্ত্রাসী সংগঠন নয় বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চে সিরিয়ার বিশ্বাসযোগ্য শাসক হিসেবেই পরিচিতি পাবে তাহরির আল-শাম।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আল-কায়েদার বিশ্বব্যাপী খেলাফত ধারণা থেকে সরে এসে শুধুমাত্র সিরিয়ায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিতে চায় তারা।
সিরিয়ায় ‘নতুন যুগের সূচনা’ ঘোষণা বিদ্রোহীদের:
সিরিয়ায় ‘নতুন যুগের সূচনা’ ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধীরা। একইসঙ্গে প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তারা। রোববার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
সংবাদমাধ্যমটি তার লাইভ আপডেটে জানিয়েছে, সশস্ত্র বিরোধী দল বলছে— “নতুন সিরিয়া” হবে “শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের” স্থান, যেখানে ন্যায়বিচারের জয় হবে এবং সমস্ত সিরিয়ানদের মর্যাদা রক্ষা করা হবে।
বিদ্রোহীরা এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা অন্ধকার অতীতের পাতা উল্টে দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছি।”
সিরিয়ার সশস্ত্র বিরোধী দল বলছে আল-আসাদের সরকারের অবসান সিরিয়ার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি ইসলামিক সশস্ত্র গোষ্ঠী এই অভিযানের নেতৃত্বে রয়েছে এবং তারা তাদের টেলিগ্রাম হ্যান্ডেলে বলেছে, এর মাধ্যমে একটি অন্ধকার যুগের অবসান ঘটল এবং একইসঙ্গে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটেছে।
এছাড়া দামেস্কের পথে পথে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে উল্লাস করতে দেখা গেছে।
বিদ্রোহীরা এক বিবৃতিতে বলেছে, “বাথিস্ট শাসনের অধীনে ৫০ বছরের নিপীড়ন এবং ১৩ বছরের অপরাধ, অত্যাচার এবং বাস্তুচ্যুতি ও দীর্ঘ সংগ্রামের পরে, সমস্ত ধরনের দখলদার বাহিনীর মোকাবিলা করার পরে আমরা আজ ৮ ডিসেম্বর সেই অন্ধকার যুগের সমাপ্তি এবং সিরিয়ার জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা ঘোষণা করছি।”
বিদ্রোহীরা বলছে, আসাদ সরকারের নিপীড়নের শিকার শত শত মানুষ যারা কারাবন্দি ও বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন তারা এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারেন।
এদিকে রাজধানীর সবচেয়ে বড় কারাগার সেদনায়া থেকে হাজার হাজার বন্দিকে মুক্ত করেছে বিদ্রোহীরা। এছাড়া সিরিয়া বিভিন্ন শহর থেকে হেজবুল্লাহ বাহিনী তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। এই পরিস্থিতিকে একজন বিশ্লেষক “৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের চূড়ান্ত মূহুর্ত” হিসেবে বিবিসির কাছে বর্ণনা করেছেন।
দামেস্কে রাস্তায়-রাস্তায় উল্লাস:
বিদ্রোহী যোদ্ধারা প্রায় বিনা বাধায় রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়ার পর বিমানে করে অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে শহরটি ছেড়ে যান আসাদ। এরপরই মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির রাজধানীতে রাস্তায় নেমে এসেছেন হাজার হাজার মানুষ।
তারা উল্লাস প্রকাশের পাশাপাশি ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে বিভিন্ন স্লোগানও দেন।
কোনও সন্দেহ নেই যে- এটি সিরিয়ার যুদ্ধে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির নিয়ন্ত্রণের জন্য বিরোধীদের যারা বছরের পর বছর ধরে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তাদের কাছে।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, হাজার হাজার মানুষ গাড়িতে এবং পায়ে হেঁটে দামেস্কের প্রাণকেন্দ্রে জড়ো হচ্ছেন। “স্বাধীনতা” স্লোগান দিচ্ছেন তারা।
এছাড়া অনলাইনে পোস্ট করা বেশ কিছু ভিডিওতে দামেস্কের উমাইয়াদ স্কোয়ারে বেশ কিছু লোককে পরিত্যক্ত সামরিক ট্যাংকের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে এবং আনন্দ উদযাপনে গান গাইতে দেখা গেছে। আল জাজিরা এসব ভিডিও ফুটেজের সত্যতা যাচাই করেছে।
এদিকে দামেস্কে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। বেশ কিছু ভিডিওতে সিরিয়ার রাজধানী থেকে সরকারি সৈন্যদের শহর ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আল জাজিরা এসব ফুটেজেরও সত্যতা যাচাই করেছে।
প্রসঙ্গত, বাশার আল-আসাদ ২০০০ সাল থেকে সিরিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন। এর আগে তার বাবা হাফেজ আল-আসাদ ২৯ বছর দেশটি শাসন করেছিলেন।
বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বাশার আল-আসাদ?
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের তড়িৎগতির আক্রমণের মুখে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসান ঘটেছে। দেশটির ইসলামপন্থী সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) রোববার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘রাজধানী দামেস্ক এখন আসাদ মুক্ত।’’ বিদ্রোহীদের দামেস্কের প্রাণকেন্দ্রে ঢুকে পড়ার সময় ব্যক্তিগত একটি বিমানে করে উড়াল দিয়েছেন বাশার-আল আসাদ। কিন্তু বর্তমানে তিনি কোথায় রয়েছেন, সেই বিষয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, বাশার-আল আসাদ সম্ভবত সিরিয়ার বাইরে রয়েছেন।
যদিও সিরিয়ার দুটি নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিমান দুর্ঘটনার মারা যাওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দামেস্ক থেকে তাকে বহনকারী বিমানটি উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে অনেকটা আকস্মিকভাবে দিক পরিবর্তন করে। বিমানের এই দিক পরিবর্তন নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে বিমানের চলাচল পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার বলছে, আসাদকে বহনকারী বিমানটি সিরিয়ার মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ফ্লাইটরাডারের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্রোহীরা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দখল নেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই একটি বিমান দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করেছে। বিমানটি প্রাথমিকভাবে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে উড়েছিল। ওই অঞ্চলটিতে আসাদ-সমর্থিত আলাউইত সম্প্রদায়ের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু সেখানকার আকাশে পৌঁছানোর পর আকস্মিক ইউ-টার্ন নেয় বিমানটি। এরপর কয়েক মিনিটের জন্য বিপরীত দিকে উড়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় বিমানটি।