রাজধানীর উপকন্ঠে টঙ্গীতে একটি ফাইভ স্টার আদলে এক হোটেলে প্রতি সপ্তাহে টিকটক গ্রুপের পুল পার্টির আয়োজন হয়। এই পুল পার্টিতে উঠতি বয়সের তরুণীরা অংশ নেয়। তারা টিকটক ভিডিও প্রদর্শন করার পর যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের মধ্য থেকে পাচারের জন্য বাছাই করা হত। টিকটক মডেল করার লোভ দেখিয়ে পুল পার্টি থেকে কয়েকশ’ তরুণীকে পাচার করা হয়েছে প্রতিবেশী ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এই চক্রের মাধ্যমে এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক তরুণীকে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়েছে।
র্যাব জানায়, বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশের এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতের বেঙ্গালুরু পুলিশ রিফাজুল ইসলাম বাবু ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু, সাগর, মোহাম্মদ বাবা শেখ, হাকিল ও দুই নারীসহ মোট ৬জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় ২৭শে মে রাতে তরুণীর বাবা হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি অ্যাক্টে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক বাবুসহ আরও চারজনকে আসামি করা হয়। এ ঘটনার সূত্র ধরেই আশরাফুল মণ্ডল ওরফে বস রাফি ও তার সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা (৪৬), মো. ইসমাইল সরদার (৩৮) ও মো. আব্দুর রহমান শেখকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর, ও বেনাপোল হতে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
র্যাবের তথ্যমতে, চক্রটি বিভিন্ন প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও তরুণীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করত। দেশী বিদেশীসহ প্রায় ৫০ জন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। চক্রের মূলহোতা বস রাফি এবং গ্রেপ্তারকৃত অন্যান্য সদস্যরা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এছাড়া ভারতে গ্রেপ্তার টিকটক হৃদয় তার অন্যতম সরবরাহকারী বা এজেন্ট। এছাড়া তার আরও এজেন্ট বা সরবরাহকারী রয়েছে। টিকটক হৃদয় অনলাইনে টিকটক ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপের তরুণীদের টিকটক মডেল বানানো ও অন্যান্য প্রলোভন দেখিয়ে উশৃঙ্খল জীবনে আকৃষ্ট ও অভ্যস্ত করাতো। পরবর্তীতে তাদেরকে পার্শ্ববর্তী দেশ বা উন্নত দেশের বিভিন্ন মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন ধরণের ভালো বেতনের চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে যৌনবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যেই ভারতে পাচার করতো। সেখানে পাচারের পর তাদেরকে বিভিন্ন নেশা জাতীয় ও মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে জোরপূর্বক অশালীন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করত যাতে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হয়।
কাওরানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার এ কে খন্দকার আল মঈন বলেন, তরুণীদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হত। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি করত। প্রথমত ভুক্তভোগীদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান হতে সীমান্তবর্তী জেলা যেমন, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসত। তারপর তাদেরকে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে যেত। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইন ম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করাতো। পরে পাশ্ববর্তী দেশের এজেন্টরা তাদেরকে রিসিভ করে সীমান্ত নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখত। সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে পাঠাতো। সুবিধা মত সময়ে কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু পাঠাতো। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর রাফি তাদের রিসিভ করে বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে যেত। পরে ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্ত করে অমানবিক নির্যাতন করতো। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করার সময় বিভিন্ন সেইফ হাউজগুলোতে তাদের জোরপূর্বক মাদক সেবন এবং পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো। সেইফ হাউজগুলো হতে তাদের ১০/১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে সরবরাহ করা হতো। এক্ষেত্রে পরিবহন ও খদ্দেরের নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নেয়া হতো।
র্যাব জানায়, রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণী। বাঙ্গালুরে ট্যাক্সি চালক, হোটেলে রিসোর্ট কর্মচারী ও কাপড়ের ব্যবসা করত। পরে সে সেখানেই তামিল ভাষা রপ্ত করেছিল। একপর্যায়ে সে রিং লিডার হয়ে যায়। দুই বছর আগে তার সাথে টিকটক হৃদয়ের পরিচয় ঘটে। সে টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণীকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে। টিকটক হৃদয় ছাড়াও তার অন্যান্য এজেন্ট রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্ট তাকে খদ্দের প্রতি ১০/১৫ হাজার টাকা কমিশন দিত। ব্যাঙ্গালুরে যে তরুণীকে নির্যাতন করা হয়েছে সে মূলত দুজন বাংলাদেশী নারীকে দেশে পালিয়ে আসতে সহযোগিতা করায় তাকে নির্মম অত্যাচার করা হয়। তাকেও বলা হয় সে যদি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে ভিডিওটি তার স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে।
র্যাব আরো জানায়, রাফির অন্যতম নারী সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা। তার তিনটি বিয়ে হয়েছে। সে এবং তার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরে অবস্থান করছে। ভাইরাল ভিডিওতে তানিয়াকে সহযোগী হিসেবে দেখা গিয়েছে। সাহিদা দেশে একাধিক সেফ হাউস পরিচালনা করছে। সাহিদা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত। এছাড়া গ্রেপ্তার ইসমাইল ও আরমান শেখ মূলহোতা বস রাফির বিশেষ সহযোগী হিসেবে পাচার তদারকি করে থাকে। তারাও নারী পাচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।