মোঃ আনিসুর রহমান : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।
আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কীভাবে কী হলো? চলুন আজ ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্যে রাজপথে আন্দোলন হয়।
বাংলার দামাল ছেলেরা পাকিস্তানি সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণদান করে, শহীদ হয়। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি এই ভাষা।
সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-জব্বার আরও কত শহীদের আত্মত্যাগে আমরা ফিরে পেয়েছি আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা।
জাতিসংঘের স্বীকৃতির ফলে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে।একুশে ফেব্রুয়ারি কীভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হল?
দিনটি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেসকোর ৩০তম অধিবেশন বসে। ইউনেস্কোর ঐ সভায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পাস হয়।
ফলে পৃথিবীর সব ভাষাভাষীর কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দিন হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পায়। বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে বাংলা ভাষা।
এবং এর পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে এই পবিত্র দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়।
মহান ভাষা আন্দোলনের দিন হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রত্যেক বছর মর্যাদার সাথে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে পালিত হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে ‘বাংলা ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে এই দিনটি।
উল্লেখযোগ্য যে, ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করার আগে, এই দিনটি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্যে বাংলাদেশে উঠতে থাকে।
বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে প্রথম সফল উদ্যোক্তারা হলেন কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠী।
এই গোষ্ঠী প্রথমে ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। সেখানে তাঁরা বলেন, বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেটা ছিল তাদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এবং এই কারণেই মাতৃভাষা দিবসের দাবিটি ন্যায়সংগত।
আরো জানাই যে, মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠীর চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সাত জাতি এবং সাত ভাষার ১০ জন সদস্য।
জাতিসংঘ মহাসচিবের অফিস থেকে পত্রপ্রেরকদের জানানো হয়; বিষয়টির জন্য নিউইয়র্কে নয়, যোগাযোগ করতে হবে প্যারিসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন ইউনেসকোর সঙ্গে।
তবে বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি ইউনেসকো।
কানাডাপ্রবাসী বাঙালি আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন মনেপ্রাণে। টেলিফোনে-চিঠিতে সবরকমভাবে।
১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ ইউনেসকো সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা আন্না মারিয়া একটি চিঠিতে রফিকুল ইসলামকে জানান, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার তোমাদের অনুরোধটি বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন কর্মকর্তার কাছে এই প্রথমবারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। আন্না মারিয়া জানান, বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই, ইউনেসকোর পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে সভায় এটি তুলে ধরা হবে।
রফিকুল ইসলামকে ইউনেসকো পরিচালনা পর্ষদের কয়েকটি সদস্য দেশের ঠিকানা পাঠিয়ে দেন মারিয়া। এখানে বাংলাদেশ ছাড়াও নাম ছিল ভারত, কানাডা, ফিনল্যান্ড ও হাঙ্গেরির।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের বিষয়টি নিয়ে ইউনেসকোতে দুটি সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, ইউনেসকো ভেবেছিল, এমন একটা দিবস পালন করতে গেলে অনেক টাকাপয়সা প্রয়োজন হবে।
একই সঙ্গে ইউনেসকো মহাপরিচালক International Mother Language Day নয়, International Mother Tongue Day নামে একে পরিচিত করতে চান। মহাপরিচালক এ জন্য এক লাখ ডলারের ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব করেন এবং দুই বছর পর নির্বাহী পরিষদের ১৬০তম অধিবেশনে একটি সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরার আদেশ দেন।
এর ফলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার বিষয়টি আটকা পড়ে যায়।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক।
এদিকে ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায় তাদের আপত্তি ছিল না। তবে তারা ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। পাশ্চাত্য দেশগুলোর কাছে শিক্ষামন্ত্রী যুক্তি ও আবেগের সঙ্গে এই বিষয়টি তুলে ধরেন যে পৃথিবীতে বাঙালিরা মাতৃভাষার অধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছে। সেটা ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে। তখন ইউরোপীয়দের ব্যাপারটা বোধগম্য হয়।
বহু সংগ্রামের পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারি লাভ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা।
১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ বাংলা ভাষার বিশ্ববিজয় তো বটেই; পৃথিবীর সব মাতৃভাষারই জয়।
বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক, ভাষার জয় হোক।