মোঃ আনিসুর রহমান : জাগৃতি, আন্দোলন আর সংগ্রাম। একটি ভাষণ। অতঃপর মরণপণ যুদ্ধ। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। দুনিয়ার বুকে এ এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি। ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন।
১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মূল অনুপ্রেরণা দেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত একটি ভাষণ। সীমাহীন উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা ও চরম অনিশ্চয়তার দিনগুলোতে ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐ একটি ভাষণে তিনি বঞ্চিত-শোষিত সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তুলেছিলেন।
বিশ শতকের (১৯০১-২০০০) ইতিহাস খুবই বৈচিত্র্যময়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে যেমন সংঘটিত হয়েছে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ ও ১৯৩৯-১৯৪৫); তেমনি দুনিয়া কাঁপানো রুশবিপ্লব (১৯১৭), দীর্ঘ প্রতীক্ষিত উপমহাদেশের বিভক্তি তথা ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা (১৯৪৭) এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ (১৯৭১) অনেক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনারও নীরব সাক্ষী বিশ শতক। বলতে গেলে কাছাকাছি সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবির্ভাব ঘটে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, উইনস্টন চার্চিল, এফ কেনেডি এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের। দুনিয়ার দেশে দেশে অনেক ক্ষণজন্মা মনীষী ও রাজনীতিকের আবির্ভাব ঘটলেও বিগত শতকের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন যেসব ভাষণ দিয়েছেন তার মধ্য থেকে সূক্ষ্ম জরিপের ভিত্তিতে চারটিকে উল্লেখযোগ্য ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত করে লন্ডনের টাইম সাময়িকী (১৯৯৮)। কালজয়ী ও দিক-নির্দেশনামূলক এক-একটি ভাষণের স্রষ্টা উল্লিখিত চার মহান ব্যক্তি। তাদের মুখের স্বস্তি ও আশাজাগানিয়া মূল্যবান ভাষণ অতীতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণকেও অনেকখানি ম্লান করে দেয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ শতকের অন্যতম আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। এই যুদ্ধের সূচনাপর্বে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দিক-নির্দেশনামূলক এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণটি ইতিমধ্যে ইউনেস্কোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ১৯৩৩ সালে অভিষেক অনুষ্ঠানে দিয়েছিলেন তার বিখ্যাত সেই আশাজাগানিয়া ভাষণটি। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ। ১৯৪০ সালের জুন মাসে পার্লামেন্টে যখন তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন তখন রণ-দামামায় ধরণি প্রকম্পিত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ১৯৬১ সালে অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘…প্রিয় দেশবাসী, দেশ আপনার জন্য কী করতে পারল তা নিয়ে প্রশ্ন করবেন না, বরং আপনি দেশকে কি দিতে পারবেন তা নিয়ে চিন্তা করুন।’ আমেরিকার বিশিষ্ট নাগরিক-অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনের মলে দাস প্রথার বিরুদ্ধে তার বিখ্যাত ভাষণটি প্রদান করেন। আর বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির ঘোর দুর্দিন ও চরম অনিশ্চয়তার মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ প্রদত্ত ভাষণে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ২৩ বছর ধরে বঞ্চিত অবহেলিত ও শোষিত বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করেন, জাগিয়ে তোলেন। বজ্রকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আঠারো মিনিটের ভাষণে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান।
রুজভেল্ট, চার্চিল, কেনেডি, লুথার ও মুজিব—তারা সবাই কথা বলেছেন শান্তির পক্ষে, সৌভ্রাতৃত্বের পক্ষে। তারা সবাই চেয়েছেন যুদ্ধের অবসান, দাসত্বের অবসান। অন্যায় ও বৈষম্যের অবসান। বলেছেন অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো—বিশ্বমানবতার পূজারি শান্তি ও মুক্তির অগ্রদূত, ভাষা ও ভাবের সফল কারিগর এসব ব্যক্তিত্বের মধ্যে অন্তত তিন জনকে (জন এফ কেনেডি-১৯৬৩, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-১৯৬৮ ও শেখ মুজিবুর রহমান-১৯৭৫) জীবনসাধনার মধ্যভাগে এসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই অল্প সময়ের ব্যবধানে নিষ্ঠুর ঘাতকের কালো থাবায় করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়।
খুবই গৌরব ও আনন্দের কথা যে উল্লিখিত কালজয়ী চারটি সেরা ভাষণের একটি হলো আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া। জাতির ক্রান্তিলগ্নে এ ভাষণ থেকেই আপামর জনসাধারণ অন্যায়, অবিচার, জুলুম আর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।’