গত মাসে ঝড়ের গতিতে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে আফগানিস্তানের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছিল। এরপরই তালেবান সারা বিশ্বকে আশার কথা শুনিয়েছিল। আফগানিস্তান আর আগের মতো হবে না। এদেশ সবার, সবাই স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে। নারীরাও স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে। পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে মিডিয়া।
সরকারে সব জাতির মানুষের প্রাধান্য থাকবে। তখন অনেক বিশ্লেষকই মনে করেছিলেন, আগের সেই তালেবান আর নেই। পরিবর্তন এসেছে এবং ভবিষ্যতে আরো হবে। কিন্তু তালেবানের সরকার গঠন সবাইকে বিস্মিত করেছে। এখন অনেকেই আশাহত। আফগানিস্তান আবার অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ফিরে যাচ্ছে এমনই আশঙ্কা সবার। ৯/১১ হামলার নির্মম দিনে শপথ নিতে চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর চাপে ও কাতারের মধ্যস্থতায় সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে তালেবান।
কথা কাজে মিল নেই : তালেবান সরকারের বর্তমান উপপ্রধানমন্ত্রী মোল্লা আবদুল ঘানি বারাদার বলেছিলেন, আমরা এমন একটা সরকার গঠন করছি যেখানে সব আফগানদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। আর তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছিলেন, আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই, দেশের ভেতরে-বাইরে শত্রু চাই না। গত বছর শান্তি চুক্তির পর নারীদের নিয়ে তালেবান বলেছিল যে, একজন প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়া যে কোনো পদে নারীদের ভূমিকা থাকবে, এমনকি মন্ত্রী পদেও। তালেবান মুখে ভালো ভালো কথা বললেও সরকার গঠনে তার প্রমাণ নেই। তালেবানের নেতৃত্বে বয়স্করা। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আমির হেবাতুল্লাহ আখুন্দাজাদা।
পুরোনো তালেবান সরকারের নৈতিকতা সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়টি পুনর্বহাল করা হয়েছে। মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাদ দেওয়া হয়েছে। সরকারের সদস্যরা বেশির ভাগই পশতু জাতিগোষ্ঠীর। মন্ত্রীসভায় রয়েছেন একজন তাজিক এবং একজন হাজারা। তারা দুজনেই তালেবানের সদস্য। একজন নারীকেও মন্ত্রীসভায় স্থান দেওয়া হয়নি। এমনকি উপমন্ত্রীর মর্যাদায়ও নারী নেই। নতুন সরকারে আছেন পুরোনো তালেবান নেতা এবং নতুন প্রজন্মের মোল্লাহ ও সামরিক অধিনায়করা। গত ২০ বছর ধরে যারা তালেবানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাই মন্ত্রীসভায়। সরকারে রয়েছে গুয়ানতানামো বে থেকে ফিরে আসা কিছু সদস্য; যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত কজন সদস্য। এদের মধ্যে কিছু নাম চোখে পড়ার মতো। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোল্লাহ হাসান আখুন্দ জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা তালিকায়।
ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি যার ছবি খুঁজে পাওয়া বিরল। শুধু মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের একটি পোস্টারে তার চেহারা দেখা যায়। এফবিআই তার মাথার দাম ধরেছে ৫০ লাখ ডলার। হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান তিনি। আফগানিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নৃশংস হামলার জন্য হাক্কানি নেটওয়ার্কের খ্যাতি রয়েছে। যদিও হাক্কানি পরিবার বলছে, তাদের কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নেই এবং তারা এখন তালেবানের সদস্য। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লাহ ইয়াকুবের কোনো ছবি নেই। মন্ত্রীসভার তালিকায় তার ছবির জায়গাটা ফাঁকা। তিনি তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লাহ ওমরের ছেলে।
আফগানিস্তানে নারী : দেশটিতে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে দেড় কোটি পুরুষ এবং ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি নারী। নারীদের অধিকার বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালের সংবিধানে নারীদের পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়। ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে নারীরা ছিল গৃহবন্দি। ১০ বছরের বেশি বয়সের মেয়েদের শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। ২০০১ সালে তালেবান সরকারকে হটিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতায় আসে হামিদ কারজাইয়ের সরকার। নারীরা আবার অধিকার ফিরে পায়। তাদেরকে শিক্ষা, গাড়ি চালনা, অলিম্পিক এবং ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের সংবিধান অনুযায়ী, ২৫০ আসনের পার্লামেন্টে ২৭ শতাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। রাজনীতিতেও আফগান নারীদের আধিপত্য বেড়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত আফগান সরকারে ২১ শতাংশ নারী ছিল। সরকারের উচ্চপর্যায়ে ১৬ শতাংশ। এখন নারীদের কাজে যোগ দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ফাওজিয়া কুফি, জারিফা গাফারি এবং সালিমা মাজারি রাজনীতিতে অতি পরিচিত নাম। ২০১৪ সালে কুফি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্বের ‘১৫০ ভয়হীন নারী’র তালিকায় ছিলেন। কুফি বলছিলেন, তালেবানরা ফিরে আসায় নারীরা আবার ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। তারা বিক্ষোভও করতে দিচ্ছে না। তালেবান এখন বিশ্বের সুপারপাওয়ারকে ভয় পায় না, তাদের ভয় নারীদের নিয়ে।
শিক্ষা না নিলে আবার ক্ষমতাচ্যুত! : তালেবান হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠন করেছে। গত বছর দোহায় শান্তিচুক্তির পর তালেবান ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা করবে না এমন ইঙ্গিত দিলেও কথা রাখেনি। সাবেক এমপি ফাওজিয়া কুফি বলেন, আফগানিস্তানের সামাজিক বুনন সম্পর্কে যারা জানেন না তারা গুরুতর চ্যালেঞ্জর মুখোমুখি হবে। সম্প্রতি মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, মার্কিন সৈন্যরা আবার আফগানিস্তানে যাবে। তার এই বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তালেবান যদি আগের মতো শাসন পরিচালনা করতে চায় তাহলে পরিস্থিতি সেই দিকেই মোড় নিতে পারে। এমনকি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও জোরালো হচ্ছে। আবার তালেবানের সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য ভারত সফর করেছেন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর প্রধান এবং রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। সিআইএ প্রধান পাকিস্তানও সফর করেছেন। পাকিস্তানে আট দেশের গোয়েন্দা প্রধানদের বৈঠক হওয়ার কথা। ফলে আঞ্চলিক তথা বিশ্বের রাজনীতি অনেকটাই আফগানিস্তানকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। তালেবানের ক্ষমতা দখলে বিশ্বে উগ্রপন্থা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
স্বীকৃতি নিয়েও তালেবান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ এখন আফগানিস্তানের পথে পথে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, সারা বিশ্ব গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য রাখছে। তালেবান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব শিগিগরই স্বীকৃতি পাবে এমন সম্ভাবনা কম বলে মতামত দিয়েছে রাশিয়ার নেজাভিসিমিয়া গাজেটা পত্রিকার এক সম্পাদকীয়। শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালেও রাশিয়া অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়েছে। কেবল চীন এবং পাকিস্তান পুরোপুরি তালেবানের সঙ্গে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
চীন ৩ কোটি ডলারের বেশি অর্থসহায়তা দিয়েছে। কিন্তু এখনই কেউ স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। আফগানিস্তানের ৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বিদেশের ব্যাংকে আটকা আছে যার মধ্যে ৭ বিলিয়ন ডলারই যুক্তরাষ্ট্রে। তালেবানের তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকেও একটি চ্যালেঞ্জ উঠে আসছে। সম্প্রতি এক তরুণ তালেব বলেন, ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তালেবান আগের মতো জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে ২০০১ সালের পূর্ববর্তী সরকারের মতোই আবার তারা ক্ষমতাচ্যুত হবে। তালেবানের সরকার নিয়ে আরেকটা অস্বস্তির কারণ হলো কেবল ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছেন এমন অনেক নেতাকে নানা ধরনের পদ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন মন্ত্রী বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন এবং সমালোচনার মুখে পড়েছেন। আর আফগানরাও আগের মতো নেই। তালেবান ক্ষমতায় আসার পরই বিক্ষোভ শুরু হয়, এমনকি সরকার গঠনের দিনেও নারীরা বিক্ষোভ করেছে।
২০০১ সালের আগের নারী এবং আজকের নারী এক নয় বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তালেবানের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও নারীরা কাবুলসহ বিভিন্ন প্রদেশে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। সন্ত্রাসবাদীদের অভয়ারণ্য, মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ এবং গভীর অর্থনৈতিক সংকট তালেবানের নতুন সরকারের সঙ্গে যারা কাজ করার চেষ্টা করছেন তাদের মাথায় এসব দুর্ভাবনা আছে। অন্যদিকে নতুন সরকার চেষ্টা করছে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে। কিন্তু সামনের এক ভিন্ন ধরনের ভবিষ্যতের চেয়েও তারা এখনো ডুবে রয়েছে অতীতে।