ইনডেমনিটির রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে না। দণ্ডিত হলেই সিইসি ও ইসি পদের জন্য অযোগ্য হবেন। আর নির্বাচন কমিশনের এ দুটি পদে স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য পেশাজীবীও নিয়োগ পাবেন। যোগ্যতা-অযোগ্যতার এ দুটি বিষয়ে পরিবর্তন এনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবিত আইনটি চূড়ান্ত করেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থয়ী কমিটি।
সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে বিলটি চূড়ান্ত করা হয়। কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার এতে সভাপতিত্ব করেন।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আগের দিন রোববার ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। কমিটির বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা শেষে জাতীয় সংসদে দেওয়ার জন্য প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। বুধবার সংসদ অধিবেশনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে।
প্রস্তাবিত মূল বিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারের যোগ্যতা-অযোগ্যতার দফা ৬-এর(গ) উপদফায় বলা হয়েছিল, ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনার (ইসি) হওয়ার অযোগ্য হইবেন।’
এখানে পরিবর্তন এনে দুই বছর শব্দটি বাদ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যে কোনো মেয়াদে সাজা হলেই তিনি সিইসি এবং ইসি হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে দণ্ড বলতে কারাদণ্ড হতে হবে।’
সিইসি এবং ইসি হওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতার ধারায়ও কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ সম্পর্কে প্রস্তাবিত বিলের ৫-এর (গ) ধারায় বলা আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হতে গেলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি বা বেসরকারি পদে তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই ধারায় সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি বা বেসরকারি পদের পাশাপাশি ‘স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য পেশা’ যুক্ত করা হবে। এখানে পরিবর্তন এনে বলা হয়েছে, ‘স্বায়ত্তশাসিত ও পেশাজীবী (যারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত) তাদের মধ্য থেকেও সিইসি এবং ইসি হতে পারবেন।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মূলত এ দুটি পরিবর্তন এনে কমিটির বৈঠকে প্রস্তাবিত বিলটি চূড়ান্ত করেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বুধবার চূড়ান্ত বিলটি প্রতিবেদন আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে। কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার এটি উত্থাপন করবেন।
বৈঠক শেষে এ প্রসঙ্গে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে আমরা প্রস্তাবিত বিলটি চূড়ান্ত করেছি। বুধবার এটি প্রতিবেদন আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে।’
ওইদিনই বিলটি জাতীয় সংসদে পাশ হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘বিল পাশ হওয়ার বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয় দেখবে। তবে আমরা আশা করছি হয়তো রিপোর্ট উত্থাপনের পরদিনই এটি পাশ হতে পারে।’
সংসদে উত্থাপিত বিলটিকে আগের সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশনকে ‘বৈধতা’ দেওয়া হচ্ছে বলে যে আলোচনা রয়েছে- সে বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘ইনডেমনিটি বলছে অনেকে। ইনডেমনিটি নয়। বিলের ৯ দফায় কিন্তু আগের দুটো সার্চ কমিটির বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ওই দুই সার্চ কমিটিকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়েছে। একটা লিগ্যাল সাপোর্ট দেওয়া। সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতি ঐকমত্যের ভিত্তিতে করেছিলেন। সেটাকে সাপোর্ট দেওয়া হলো। কোনো দায়মুক্তি নয়। আর আইনটা কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে। সার্চ কমিটির আইন নয়।’
তবে বিলে পরিবর্তনের বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। কমিটির বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকর্মীরা এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিলে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে কি পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেটা আমি এখানে বলছি না। এটা সংসদ আগে জানার অধিকার রাখে। আমি যেদিন বিলটি জাতীয় সংসদে পাশের জন্য উত্থাপন করব সেদিনই বিলটির পরিবর্তন সম্পর্কে বলব।’
সবাইকে অন্ধকারে রেখে অনেকটা তাড়াহুড়া করে আইনটি পাশ করা হচ্ছে- বিরোধীদের এমন সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, এখানে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। গোপনীয়তারও কিছু নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেকে এই আইন নিয়ে বিতর্ক ছড়াচ্ছেন। বাস্তবতা ভিন্ন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জাতীয় সংসদে আইনটি উত্থাপনের পর এটি আর কীভাবে গোপন থাকে, আমার তা বোধগম্য নয়।
এই আইনের মাধ্যমে অতীতের দুই নির্বাচন কমিশনকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে-বিরোধীদের এমন দাবির জবাবে অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, এখানে ইনডেমনিটি দেওয়ার কিছু নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটা বলা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটির রাজনীতি করে না। আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটির শিকার। ইনডেমনিটি দেয় না। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ইনডেমনিটি কারা দিয়েছিল? ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স কারা করেছিল? বরং আওয়ামী লীগই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেছিল। এখানে কাউকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়নি।
মন্ত্রী বলেন, আইনে দুটো জিনিস আছে। একটা হচ্ছে ইনডেমনিটি আর একটা হচ্ছে লিগ্যাল কাভারেজ। দুটো কিন্তু এক জিনিস নয়। ইনডেমনিটি হচ্ছে মাফ করে দেওয়া, তাদের আইনের আওতা থেকে বের করে দেওয়া। লিগ্যাল কাভারেজ হচ্ছে আইনের ভেতরে আনা। দফা-৯ এ পরিষ্কারভাবে পড়ে দেখেন কারও কৃতকর্মকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়নি।
বৈঠকে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ছাড়াও আরও উপস্থিত ছিলেন- কমিটির দুই সদস্য জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি এবং বিএনপির ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা।
আইন সম্পর্কে কমিটির বিএনপিদলীয় সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, নিশ্চয়ই সব ব্যাপারে একমত হওয়া যায় না। খুব তড়িঘড়ি করে আইনটি হয়েছে। একদিনের বৈঠকে আইনটিতে পৌঁছে গেছি। আইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার দরকার ছিল, কিন্তু সেটা করা হয়নি।
কিছু বিষয়ের উত্তর পাননি দাবি করে তিনি বলেন, সার্চ কমিটি যে নামগুলো রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন, সেই নামগুলোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য দিতে হবে এটা আমি বলেছি। জাতিকে জানতে হবে সার্চ কমিটি কোন কোন নামগুলো প্রস্তাব করছে রাষ্ট্রপতির কাছে। এসব প্রশ্নের ব্যাপারে আশানুরূপ উত্তর পাইনি।