‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কটির নাম বন্ধুত্ব’- এরিস্টটলের এই চিরসত্য বাক্যটির গভীরতা কতটা, তা তখনই বোঝা যায় যখন জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় সত্যিকারের একজন বন্ধু। ইংরেজি সাহিত্যের লেখক ভার্জিনিয়া উলফ তিনিও বলেছেন, কেউ কেউ পুরোহিতের কাছে যায়, কেউ কবিতার কাছে,
আমি যাই বন্ধুর কাছে।’ যুগ যুগ ধরে বন্ধুত্ব সম্পর্কটি আলাদা এক স্থান তৈরি করে নিয়েছে। বলা হয়ে থাকে জীবনের কোনো এক বাঁকে নয়, বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি সারা জীবনব্যাপী।
বন্ধুত্ব যদি নিখাদ হয় তবে জীবনের কোনো বাঁকেই নাকি তা শেষ হওয়ার নয়। সত্যিকার একজন বন্ধু যেমন সুখের সময় পাশে থাকেন, ঠিক তেমনি দুঃখের দিনগুলোতেও লড়াইয়ের সাহস জোগায়।
এমনকি জীবনের লক্ষ্য তৈরিতে, একাকিত্ব ঘোচাতে, আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে একজন বন্ধু। বন্ধুর অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকেও বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে আরেক বন্ধু। গবেষণা মতে, বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটালে হ্যাপি হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে। ফলে জীবনের স্ট্রেসগুলো বিদায় জানায় ধীরে ধীরে।
বন্ধুত্বের সম্পর্ক নানাভাবে শরীর ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে থাকে। জার্নাল অব নিউরোলজি, নিউরোসার্জারি অ্যান্ড সাইকিয়াট্রি-তে প্রকাশিত বেশ কিছু গবেষণা অনুসারে একাকিত্বের সঙ্গে ডিমেনশিয়ার মতো রোগের সরাসরি যোগ রয়েছে। দেখা গেছে, যেসব মানুষের সঙ্গে বন্ধুদের সেভাবে যোগাযোগ হয় না, তারা এতটাই একা অনুভব করতে থাকেন যে ব্রেন সেলগুলো শুকাতে শুরু করে। ফলে প্রথমে মনোযোগ হ্রাস দিয়ে শুরু হয়ে শেষে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। আর যারা প্রতিনিয়ত বন্ধুদের মাঝে থাকে, তাদের কী হয়? তাদের ক্ষেত্রে একেবারে উল্টো ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে ব্রেন সেলেগুলোর কর্মক্ষমতা বাড়ার কারণে শুধু স্মৃতিশক্তির উন্নতি হয়, তা নয়। বরং সেই সঙ্গে বুদ্ধি এবং মনোযোগেরও উন্নতি ঘটে।
বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের গল্পে একটি ব্যতিক্রমী স্থান ধরে রাখতে পারে। একজন ভালো বন্ধু সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এটি কিন্তু বহু পুরনো একটি প্রবাদ। গবেষণা বলছে, যখন একজন ভালো বন্ধু থাকবে নিজেই বিষয়টির বাস্তবতা অনুভব করতে পারা যাবে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, বন্ধুত্বের শেকড় আগে যা ভাবা হয়েছিল তার তুলনায় আরও গভীরে প্রসারিত। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মস্তিষ্কগুলো অনেকটা একই রকমভাবে সাড়া দিয়ে থাকে। তাদের কতগুলো ছোট ছোট ভিডিও দেখানোর পর তারা একই রকম হাসি আনন্দের মতো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে দেখেছেন। ভিডিওগুলোর বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন রকম, উত্তেজনাপূর্ণ ফুটবল ম্যাচ, মহাকাশ পানির আচরণ ও লিয়াম নিসনের কমেডি। এরপর প্রত্যেকের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা গেছে যারা পরস্পরের বন্ধু তাদের মস্তিষ্কের ওপর ভিডিওগুলো একভাবে প্রভাব ফেলেছে। যারা পরস্পর বন্ধু নয়, তাদের ওপর প্রতিক্রিয়া হয়েছে অন্যভাবে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট ক্যারোলিন পার্কিনসন জানান, তিনি বন্ধুদের মধ্যে মিল-অমিলের অসামান্য মাত্রা দেখেছেন। এ ছাড়া ডার্টমাউথ কলেজের গবেষক থালিয়া হুইটনি ও এডাম ক্লেইনবাম জানিয়েছেন, বন্ধুদের মধ্যে পারস্পরিক মিল সম্পর্কে তারা আগে যা জানতেন নতুন সমীক্ষায় সেটি আরও গভীরভাবে দেখা গেছে। যেগুলো হলো প্রাকৃতিক যোগাযোগ।
‘কানেক্টেড: দ্য পাওয়ার অব আওয়ার সোশ্যাল নেটওয়ার্কস অ্যান্ড দ্য হিউ দ্য শেপ অব ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক ওই সমীক্ষায় ইয়েল ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী নিকোলাস ক্রিস্টাকিস জোনান জানান, সমীক্ষাটি একটি অবিশ্বাস্য রকমের তাৎপর্যপূর্ণ। যে তথ্য উদঘাটন করেছে তা হলো পরস্পর বন্ধুদের একে অপরের সঙ্গে কেবল বাহ্যিক বা আদর্শিক সাদৃশ্যই নয় বরং তাদের মস্তিষ্কের কাঠামোর মধ্যেও মিল রয়েছে।
মস্তিষ্ককে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচকভাবে দুভাবেই প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে একজন বন্ধুর। তাই বন্ধু নির্বাচনে সচেতন হওয়াটা জরুরি।