মোশাররফ হোসেন: বিশ্বকাপ ফুটবল মহাজগতকে মাতিয়ে গেল। ৩৬বছর পর আর্জেন্টিনা কাপ জিতে এখন উৎসব করছে। কাপ নিয়ে লক্ষ মানুষের সমাবেশে অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান লিওনেল মেসিসহ খেলোয়াড়রা। ভিক্টরি স্কোয়ারের সংবর্ধনা বাতিল করে দিয়ে বুয়েনারস আয়ারসের ভিন্ন জায়গায় তা সমাপ্ত করে সরকার। কাপ জয়ের নায়ক মেসিকে তার শহর রোজারিওতে সংবর্ধনা দেন শহরের মেয়র ও ফুটবল এসোসিয়েশন ।
মহাজগতের সব শ্রেণীর মানুষকে তথা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে ছাত্র ছাত্রী, কৃষক শ্রমিক যুবক যুবতী, শিশু কিশোর বৃদ্ধ পুরুষ নারীকে ফুটবল উজ্জীবিত করে রেখেছিল। এটা প্রাণের তাগিদ। ছুটি নিয়ে, সময় বের করে মাত্র তিন ঘন্টার বিনোদনে যুক্ত থাকেন সবাই ।
কোটি কোটি মানুষ মাঠে ও বাইরে থেকে এ খেলা ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন মাধ্যমে উপভোগ করেন। বিশ্বজুড়ে এতবড় আয়োজন আর নেই । টিভি চ্যানেলে প্রচারিত খেলা বড় বড় পর্দায় শহর ও গ্রামের সর্বত্র এবার খেলা দেখেছেন বাংলাদেশের ফুটবল দর্শকরা। বিশ্বজুড়ে একই দৃশ্য দেখা গেছে ।
৪৮টি দেশ নিয়ে মরূদ্যানের দেশ কাতারের দোহা এবার খেলার সফল আয়োজন করে বাজিমাৎ করেছে। দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন মাঠ ছিল আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। এমন কি সাংবাদিক সহ দর্শকরা হোটেলে জায়গা না পেয়ে ক্রুজ শিপেও আনন্দ অবগাহনে বাস করে ঐতিহাসিক স্মৃতি নিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন।
আগামী ২০২৬ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর বিভিন্ন শহরে ৬২টি দেশ চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেবে। কানাডার টরনটোয় বিএমও মাঠে খেলা হবে। ভ্যানকুভারও তৈরি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মাঠে হবে নক আউট সহ ফাইনাল। ইতিমধ্যে খেলার মাঠ চূড়ান্ত। তৈরি হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায়।
এবার জার্মানি, ইংল্যান্ড , ইতালি আগে বিদায় নেয়। প্রথমবার আফ্রিকার কোন দেশ সেমিতে খেলেছে। মরক্কো বেশির ভাগ খেলোয়াড় ইউরোপে লীগ খেলার সুবাদে তাদের পক্ষে এটা সম্ভব হয়েছে। গত রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়া ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠলেও ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নেয় ।
ফাইনাল খেলাটি ছিল প্রাণবন্ত ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ভরা। শ্বাসরুদ্ধকর। ৯০ মিনিট ২-২। ১২০মিনিট ৩-৩। অতঃপর টাইব্রেকারে ৪-২। এখানে আর্জেন্টিনার খেলার নায়ক গোলকিপার কিলিয়ানো মার্তিনেজ।
৯০মিনিটের শেষ মূহূর্তে অবিশ্বাস্যভাবে কোলা মূয়ানির জোরালো শট মারতিনেজ রুখে দিয়ে দলকে বাঁচান। আবার টাইব্রেকারে কিংসলে কোমানের শট রুখে দিয়ে দলকে জিতিয়েছেন ।
টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা চার গোল করে । মারতিনেজ বিশ্বসেরা গোলকিপার । এটা আর্জেন্টিনাকে বিশেষভাবে এগিয়ে রাখে। ফাইনাল ম্যাচ খেলোয়াড় ডি মারিয়া নেমেই গোল করেছেন। এটা বিশেষত্ব। তুরুপের তাস ।
এবার বিশ্বাসেরা নেইমার, মেসি রোনালদো, এমবাপ্পে মদরিচ এর মধ্যে নেইমার ও রোনালদোকে আগামী বিশ্বকাপে খেলাতে দেখা যাবার সম্ভাবনা কম৷ আহত না হলে এমবাপ্পেকে দেখা যাবে । মেসি অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি।
সব বিশ্বকাপে মহাতারকা হিসেবে খেলোয়াড় তৈরি হয়। ইউরোপের ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, স্পেন ইংল্যান্ড এর পেশাদার লীগ, আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা উরুগুয়ে, মেক্সিকো, চিলি,ভকলাম্বিয়ার লীগ থেকে বিশ্ব জুড়ে খেলোয়াড় তৈরি হয়। সে তুলনায় এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে খুব কম খেলোয়াড় তৈরি হয়। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান এসব লীগের দল পরিচালনা করে । ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাব বিশেষ করে বার্সেলোনা , রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান, ইনটার মিলান, পিএসজি, লিভারপুল, চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এ বিশ্ব মহাতারকা খেলোয়াড়দের খেলতে দেখা যায় রেকর্ড পরিমাণ অর্থে। সে তুলানায় লাতিন আমেরিকার সানটোস, ফেলেমিংগোর অর্থ কম। দলের সংগে কোচদের নেয়া হয়।
বর্তমানে চলছে টোটাল ফুটবলের যুগ। যার জনক নেদারল্যান্ডসের জোহান ক্রয়েফ। তবে ইউরোপের খেলা পাওয়ার ফুটবল বা প্রেসিং ফুটব। এটা মাঠ জুড়ে কিংবা এলাকা অনুযায়ী। দ্রুত গতিতে বলসহ ছুটে যাও, গোলার মত শটে গোল কর। টাফ টেয়াকেল এখন খেলার অংশ । দলের কুশলী খেলোয়াড়কে খেলতে না দেয়া । সেটা কড়া পাহাড়া কিংবা অনুসরণ করে। দুভাবে করা হয়।
অপরদিকে লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল বল ধরা রেখে সারা মাঠ জুড়ে খেলা ছড়িয়ে নীচ থেকে আক্রমণ রচনা করে। মধ্যমাঠ খেলার নিয়ন্ত্রণ করে। রক্ষণভাগ বল সহ উপরে উঠে আক্রমণে যায়। বিশেষ করে দুই উইং ব্যাক। দলে থাকে ফ্রি কিক এক্সপার্ট । রংধণু কিকে গোল। বাক নেয়া কিক। ছন্দময় খেলা । দীর্ঘকাল দেশটি ফুটবলকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলে মাঠে দর্শক টেনেছে । আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, মেক্সিকো একইরকম ফুটবল খেললেও তারা ইউরোপের খেলার কৌশল মিলিয়ে খেলছে এখন। তবে আক্রমণ যায় ঝড়ের গতিতে ।
ইউরোপের টাচ ও টাফ ফুটবলের সংগে লড়াই করতে লাতিন আমেরিকা বল ধরে রেখে ঝড়ের গতিতে আক্রমণ যায়। এখানে মূলত মহাতারকা পেলে, গারিনচা,র উত্তর সুরি রোমারিও, সক্রেটিস, বেবেতো, রোনালদো, রোনালদিনহো, দিয়াগো মারাদোনা, নেইমার, মেসি কতটুকু খেলতে পারেন? সবসময় তারা পাহাড়ায় থাকেন। যেহেতু খেলা, তারকা খেলোয়াড় মুক্ত থাকবে কেন? তারপরও বল বাদে খেলোয়াড়কে আঘাত তো খেলা হতে পারে না ।
এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে অসাধারণ খেলোয়াড় পাওয়া যাবে না । এখন যদিও রেফারি ও রিপ্লে দেখে দোষী খেলোয়াড়কে সতর্ক করা হয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
তারপরও রেফারিং মান খারাপ হয়ে যায়। যেন কোডেসালের প্রেত্মাতা বার বার ফিরে আসছে।
বিশ্ব ফুটবল সংস্থার বিশাল কার্যক্রম এবং কোটি কোটি টাকার তহবিল নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন রয়েছে।
তাদের মধ্যে আবার রাজনীতি , কূটনীতি তো আছে । দোহা রক্ষণশীলতার মধ্যেও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরো খেলা সফলভাবে সম্পন্ন করেছে । অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করলেও বিদেশী স্চ্ছোসেবক ও শিল্পীসহ উদ্বোধন ও জমকালো সমাপনী অনুষ্ঠান করে পাশ্চাত্যকে দেখিয়েছে আমরাও পারি ।
তারপরও যতই দিন যাচ্ছে ফুটবলে অতীতের তুলনায় কৃতি খেলোয়াড়, রেফারি ,কোচ, সংগঠক কমে যাচ্ছে। এর কারণ বিশ্ব ফুটবল খেলুড়ে দেশসমূহে ফুটবল পরিকল্পিত পথে এগিয়ে যাচ্ছে না। এসব দায়িত্ব যাদের তাদের মধ্যে দূরদর্শন নেই। ফুটবল দর্শণ এগিয়ে নেবার জন্য সৃষ্টিশীল ও নিবেদিত সংগঠক ও কোচের অভাব। ক্লাবের পাশাপাশি দেশের জন্য ভালবাসা খুবই কম। টাকা বড় বেশি। খেলা নয়। যদিও ব্যতিক্রম আছে । আফ্রিকা ও এশিয়া বড় অবহেলিত। লাতিন আমেরিকার ফুটবল সমৃদ্ধ করতে ফিফাকে উদ্যোগ নিতে হবে। ইউরোপের অর্থ আছে। ফুটবল কাঠামো শক্তিশালী। ফুটবলকে সমৃদ্ধ করতে হবে সবাই মিলে। শুধু বিশ্বকাপ? বাছাই পর্ব। এর বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার ফেডারেশন কাপ নিয়মিত করা দরকার। এজন্য ফিফার ফুটবল উননযন কমিটি আরও বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে ।বাংলাদেশের ফুটবল অবস্থান কোথায়? ৫০ বছরে কতটুকু এগিয়েছে। ফিফাকে জানতে হবে। মিডিয়া কভারেজ বেড়েছে। খেলার দর্শক হৃদয় জয় করে চলেছ। কিন্তু খেলোয়াড় ও সংগঠকদের মধ্যে নিবেদিত মনোভাবের বড় অভাব। কামনা করি এ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করুক বাংলাদেশ ।