মালিকুজ্জামান কাকা, যশোর : ইউরোপ মহাদেশের কয়েকটি দেশসহ যশোরের কৃষকের উৎপাদিত পটল এবার রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। কুয়েতে রপ্তানীর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে পটলের বাজারে প্রবেশ করেছে যশোর।
এখানকার সবজি জোনখ্যাত উত্তম কৃষি পরিচর্যার (জিএপি) এ পটল চাষিদের কাছ থেকে কিনে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশে রপ্তানি করছে। ন্যায্য মূল্যে পটল বিক্রি করতে পেরে চাষিরাও বেজায় খুশি। মনিরামপুর উপজেলার নদী-বাঁওড় বেষ্টিত মশ্বিমনগর, চালুয়াহাটি, হরিহরনগর ও রোহিতা ইউনিয়ন মূলত সবজি জোন হিসেবে পরিচিত। এখানে পটল ছাড়াও চাষ হয় বেগুন, কাকরোল, ভেন্ডি, টমাটো, লতিকচু, ওল, মানকচু, পেয়ারা, মাল্টা, পেপে, ফুলকপি, পাতাকপি, ওলকপি, সীম, মুলা, পুঁইশাক, ডাটা শাক, গোল আলু প্রভৃতি সব্জী।
এসব কারনে মনিরামপুর, শার্শা, ঝিকরগাছা, চৌগাছা ও সদর উপজেলা, বাঘারপাড়াকে সব্জী জোন আখ্যায়িত করা হয়। এর মধ্যে শার্শা ও ঝিকরগাছা ফুল জোন হিসাবেও পরিচিত। বিগত কয়েক বছর ধানের বাজারমূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় চাষিরা লোকসানে ছিলেন। এখন এই অঞ্চলের কৃষক ধান চাষ কমিয়ে নানা ধরনের সবজি চাষ শুরু করেছেন।
মনিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, চলতি মৌসুমে মনিরামপুরে মোট ৩১০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন সবজি চাষ করা হয়েছে। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বলেছেন, উপজেলার সবজি জোনে অন্যান্য সবজির মধ্যে শুধু পটল চাষ করা হয়েছে ৩৫০ হেক্টর জমিতে। পটলের ফলন ভালো হয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন যশোর, খুলনা, রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে পটল রপ্তানি হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ মহাদেশের দেশ ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে এই পটল রপ্তানি হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার জানান, বিদেশে রপ্তানির জন্য ইতোমধ্যে বাছাই করে সবজি জোনের প্রায় ৩০০ জন চাষিকে জিএপির আওতায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দেশে করোনা পরিস্থিতি থেকে উর্ত্তীর্ন হওয়ায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রায় অর্ধশত চাষীর উৎপাদিত পটল ইউরোপ মহাদেশের বাজারের পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে রপ্তানি।
তিনি বলেন, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আরআর এন্টারপ্রাইজ, লি-এন্টারপ্রাইজ, এমএস এন্টারপ্রাইজ, আরএম এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখানকার উৎপাদিত পটল ক্ষেত থেকে সরাসরি ক্রয় করে প্যাকেটজাত করে তারপর বিদেশে রপ্তানি করছে। পটলের পাশাপাশি আগামীতে মেটে আলু, ওল, শিম, কাকরোল, ভেন্ডি, এঁচোড় কাঠাল, বাঁধাকাপিসহ বেশ কয়েক প্রকার সবজি বিদেশে রপ্তানির জন্য চাষিদের প্রস্তুত করা হচ্ছে।
রোহিতার পলাশী গ্রামের কৃষকরা জানান, কৃষি অফিসের তত্তাবধানে গ্রামের বিভিন্ন কৃষক কেউ এক বিঘা, কেউ তিন বিঘা, কেউ ৪০ শতক জমিতে পটল চাষ করেছেন। এতে অধিকাংশ জৈবসার বিশেষ করে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) ও সামান্য কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। জৈব পদ্ধতিতে ফলন হচ্ছে ভালো।
চালুয়াহাটি ইউপির হরিশপুর গ্রামের কৃষকরা জানান, সেখানে কোন কৃষক দুই বিঘা, কেউ ২০ কাঠা, কেউ ২৪ শতক জমিতে জৈব পদ্ধতিতে পটল চাষ করেন। ফলন ভালো হচ্ছে। পটল চাষি জানান, বর্তমানে তারা বিদেশে রপ্তানিযোগ্য প্রতি কেজি পটল বিক্রি করছেন ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। এরা জানান, পটলে বেশি মুনাফা হওয়ায় তাদের দেখাদেখি আশপাশ এলাকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক চাষি এখন পটল চাষে অগ্রহী হচ্ছেন।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মণিরামপুর উপজেলার শাহপুর ও হায়াতপুর সবজি চাষের জন্য উপযোগী মাঠ। বারো মাস সবজি চাষে উপযোগী এ দু’গ্রামের মাঠের পর মাঠ সবজির ক্ষেতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সবজি চাষিদের সঠিক পরামর্শ ও উৎসাহ দেয়া হয়ে থাকে।
এ দুই গ্রাম ছাড়াও রোহিতা,মশ্মিনগর ও চালুয়াহাটী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের সবজি ক্ষেত ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, ঢেঁড়স, মুলা, লাউ, শিম, বরবটি, ক্ষীরা, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, লালশাক, পালংশাক, কলা, বেগুন, শসা, মেটে আলু, ডাটা, পটল, ঝিংগা, উচ্ছে, কাকরোল, গাজর, চিচিংগা, কাঁচাঝাল, ওলসহ বিভিন্ন ধরণের বারোমাসি সবজিতে ভরপুর। এখানে নিরাপদ ও বালাইমুক্ত সবজি উৎপাদিত হচ্ছে।
এখানে সবজি চাষে জৈব সার ব্যবহার করা হয় বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবুল হাসান। শাহপুরের সবজি চাষি আব্দার রহমান, শাহারুল, বাবু, ইকবাল হোসেন, শফিকুল ইসলাম, রাহাজুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, নুর ইসলাম, আতিয়ার রহমান, লুৎফর রহমান, মফিজুল ইসলাম, কবির হোসেন জানান, বছরের বারো মাস বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করে আমরা অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়েছি।
এখানকার উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে অন্য জেলা-উপজেলায় সরবরাহ করি। বর্তমান সময়ে সবজির দাম ভালো পেয়ে খুব খুশি আমরা। সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে যশোর, খুলনা ও ঢাকার বাজারে সরবরাহ করা হয়। পটল ও বাঁধাকপি রপ্তানী করায় সব্জীর বাজার চড়া। রাজগঞ্জ হাট-বাজারে শাহপুর ও হায়াতপুরের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সবজি পাইকারি বিক্রি করেন। রাজগঞ্জ হাট-বাজার থেকে পাইকারি দরে সবজি কিনে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় নিয়ে যান সবজি ব্যবসায়ীরা।
রোহিতা ইউনিয়ন উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা এসএম মারুফুল হক জানান, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সবজি চাষিদের সবধরণের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া নতুন জাত ও নতুন ফসল সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগের পক্ষ হতে প্রর্দশনী প্লট স্থাপন করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, এখানকার উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে যশোর জেলা শহরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রি হয়ে থাকে। এখন রপ্তানী কৃষি খাতে সুদিন ফিরিয়ে আনবে নিশ্চিতভাবে।