ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুগল। ২০ বছর ধরে সার্চ ইঞ্জিনের বাজারে একরকমের আধিপত্য খাটিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এক গুগলে যা সার্চ হয়, অন্য সব সার্চ ইঞ্জিনের সামষ্টিক সার্চিংও এর ধারেকাছে নেই।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি সেকেন্ডে সারা বিশ্বে গুগলে এক লাখ ব্যবহারকারী তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে থাকেন। যেখানে মানুষ সেখানেই বাজার। আর বাজার মানেই বিজ্ঞাপনের আখড়া। সে হিসেবে গুগল হয়ে ওঠেছে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বর্গভূমি। গ্রাহকরা বিজ্ঞাপন দেখুক বা না দেখুক, গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে জায়গা নিতে কোম্পানিগুলোকে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। ২০১১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশ। এ সময় সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির লাভই হয়েছে ৩০০ বিলিয়ন ডলার। বলা হয়ে থাকে, লাভের সিংহভাগ এসেছে গুগলের সার্চ ইঞ্জিন থেকে। বর্তমানে গুগলের বাজারমূল্য ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যা গুগলকে প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তর স্থানে জায়গা করে দিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ওপেন এআই নামের এক কোম্পানির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এএই) চ্যাটজিপিটির বাজারকাঁপানো গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্ন তুলেছে গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কী আছে চ্যাটজিপিটিতে; এর থেকে সহজ প্রশ্ন: কী নেই এখানে। মানুষের মতো চ্যাট করার পাশাপাশি চ্যাটজিপিটি তৎক্ষণাৎ লিখে দিতে পারে কবিতা বা গান, আঁকতে পারে ছবি, ইতিহাস নিয়ে লিখতে পারে দীর্ঘ রচনা এবং উত্তর দিতে পারে প্রায় যেকোনো প্রশ্নের। যেখানে গুগল সার্চ মানে গাঠনিক কোনো প্রশ্ন, সেখানে চ্যাটজিপিটি ভার্চুয়াল কথোপকথনের মাধ্যমে দিয়ে দেয় সব জিজ্ঞাসার উত্তর। পরিসংখ্যান বলছে, নভেম্বরে বাজারে আসা চ্যাটজিপিটির বর্তমান ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন। খুব শিগগিরই দ্রুততম গ্রাহক পাওয়ার দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি টিকটককে ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই। খোদ মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলছেন, ‘মানুষের জীবনে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয়তা যেমন অনস্বীকার্য, একইভাবে চ্যাটজিপিটিও হয়ে উঠবে নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় তথ্য জানার এক অনবদ্য মাধ্যম।’ সম্প্রতি গুগলের এক সাবেক কর্মকর্তা এরিক সিমিড বলেন, ‘চ্যাটজিপিটি প্রমাণ করেছে রাতারাতি কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মানুষ বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। আগে মানুষ যেসব প্রশ্ন গুগলে সার্চ করত, এখন সেগুলো চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে পারে। যেখানে গুগল হচ্ছে নিজ থেকে নথি খোঁজার এক মাধ্যম, সেখানে চ্যাটজিপিটি এক অভিজ্ঞ বন্ধুর মতো আচরণ করছে; যাকে জিজ্ঞাসা করলে ফটাফট উত্তর দিয়ে দেয়। চ্যাটজিপিটির এই ব্যবহারবান্ধবতা গুগলের জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছে।’ সহজেই বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বের টেক কোম্পানিগুলোতে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে এআই। বিশেষ করে যখন মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানি মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) ওপেন এআইতে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তখন নড়েচড়েই বসতে হচ্ছে গুগলকে। মূলত মাইক্রোসফটের সার্চ ইঞ্জিন বিং এতদিন ধরে গুগলের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর বাজার ধরতে মাইক্রোসফটের এ বিনিয়োগকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলছেন বিশ্লেষকরা। একইভাবে চীনে গুগল নিষিদ্ধ হওয়ায় তাদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন বাইদুও এআই-এর মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে বলে জানা গেছে। এদিকে বাজারে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সম্প্রতি গুগল নিজের আইএই চ্যাটবুট বার্ড বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রজেক্টে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে অ্যালফাবেট। কিন্তু বার্ড ধামাকা দেখানোর আগেই যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে বিনিয়োগকারী ও গ্রাহকদের কাছে। অ্যালফাবেটের এ ঘোষণার পর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম আট শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। নব্বইয়ের দশকে বাজারে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে ইয়াহু ও আলতাভিস্তা। তবে ১৯৯৮ সালে বাজারে গুগলের অলগারিদম সার্চ ইঞ্জিনের আবির্ভাব ইয়াহু ও আলতাভিস্তাকে পেছনে ফেলে দেয় বছর কয়েকের মধ্যে। এরপর সার্চ ইঞ্জিনের বাজারে গুগলই ছিল সর্বেসর্বা। মাঝে নিভা ও ইউ.কমের মতো কোম্পানি এলেও তা গুগলের তোপে টিকতে পারেনি। তবে অ্যামাজনের আগমন গুগলকে কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছিল। বিশেষ করে শপিং করার ক্ষেত্রে মানুষ গুগলের বদলে অ্যামজনে সার্চ করার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে গুগল বুঝতে পারে–একাংশের জনপ্রিয়তা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া বাজারে অ্যাপল, মেটা কিংবা টিকটকের দৌরাত্ম্যে টিকে থাকতে বড় রকমের মার্কেটিং পলিসি মেনেই নিজেদের জায়গা ধরে রেখেছিল গুগল। তবে চ্যাটজিপিটি যেন হাতে-পায়ে নয়, প্রথমে আঘাত হানল গুগলের মাথায়। অনেক টেক বিশ্লেষকই বলছেন, ভবিষ্যতে গুগলের বিকল্প হবে চ্যাটজিপিটি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রিসার্চ ফার্ম ইমার্কেটার পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে গুগলে দেয়া বিজ্ঞাপনের পরিমাণ ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া মানেই অর্থ ঘাটতি। আর এমন বিপদই কড়া নাড়ছে অ্যালফাবেটের দোরগোড়ায়। তবে ই-মার্কেটার বলছে, গুগল অস্তিত্বসংকটে পড়লেও অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে না। গুগলের কী হবে না-হবে, তার থেকেও বড় কথা, প্রযুক্তিতে নতুন এক যুগে প্রবেশ করল মানুষ। এখন সার্চ ইঞ্জিনগুলো আর তালিকা নয়, সরাসরি জানিয়ে দেবে উত্তর। মানুষের কাজকে আরও সহজ করে তুলবে উদ্ভাবিত এসব এআই প্রযুক্তি। একে একে বাজারে টিকে থাকতে প্রতিটি সার্চ ইঞ্জিনে লাগবে এআইয়ের ছোঁয়া–এ সত্যি এখন সহজেই অনুমেয়।