মোশাররফ হোসেন : ̄স্বাধীনতার ৫০তম বছরে মুক্তিযোদ্ধা ও সুর সাধক সাজেদুল আলম এর ভিডিও ,আলাপন ও কীর্তিগাঁথা মিলিয়ে লেখা আমাকে নতুনভাবে উজজীবিত করেছে। তার মুক্তিযুদ্ধ ও সুরের সাধনা জগতের ব্যাপ্তি চট্টগ্রাম থেকে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে ।মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সুরেলা থেকে সোলস ও এখন স্পেনে কিরওয়ানি অর্কেস্ট্রার কর্ণধার সাজেদ । সেতারসহ ৩০টি যন্ত্র দিয়ে তার সুর সাধনা ও কিরওয়ানির অনুষ্ঠান ইউরোপ ,আমেরিকা ও বাংলাদেশে ঝড় তুলেছে ।
সাজেদ গতকাল বলেন ,স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশবাসিকে আমার লালগোলাপ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। দেশের উন্নয়নে আমি গর্বিত ।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন আমার জীবনের সেরা অর্জন । সুরের মুর্ছনায় নিমগ্ন থাকলেও হৃদয়ে সবসময় লাল সবুজের বাংলাদেশ । সোলসের মত কিরওয়ানি বাংলাদেশের সুরও ধারন করে। সাজেদের বেড়ে ওঠা ,মুক্তিযুদ্ধ ও সুর সাধনা মিলিয়ে এ সাক্ষাৎকার নিয়েছি কানাডার টরেন্টো থেকে । সময় মিলিয়ে স্পেনে থেকে দীর্ঘ আলাপন ,ভিডিও ও সিডনি থেকে তার আত্মজার দেয়া তথ্য এ লেখায় কাজে লেগেছে ।
স্মৃতিতে মুখিযুদ্ধ : ১৯৭১ সালে আমাদের চট্টগ্রামস্থ’ কাজীর দেউড়ি পাড়ার জিল্লুর ,বশির হারুন ,শাহেদ ও আমিসহ সাতজন মু৩িযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম ।সেপ্টেম্বর মাসে ট্রেনে করে আখাউড়া যাবার আগে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়ি । অনেক জেরার পর ছাড়া পাই । এক পর্যায়ে ঢাকাগামী ট্রেন থেমে যায় ।প্রচন্ড গুলির মধ্যে আমরা ধানক্ষেতে লাফিয়ে পড়ি । কাদায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মরক্ষার পর ভোররাতে আমরা ভারতের সীমান্ত পার হতে সক্ষম হয়েছিলাম ।এরপর টানা দুইদিন হেঁটে আমরা ত্রিপুরার হরিনা ক্যাম্পে যাই । সেক্টর ১ এর প্রশিক্ষণ চলছিল । আমরা সেখানে নাম লেখালাম ।দুসপ্তাহ প্রশিক্ষণের পর আমাদের সম্মুখ যুদ্ধে পাঠানো হয় ।শুভপুর যুদ্ধে ব্রীজের কাছাকাছি আসতে আমাদের দুজন যোদ্ধা শহীদ হন ।শত্রুবেষ্ঠিত হয়ে পড়ায় আমাদের রসদ ফুরিয়ে যায় । দুইদিন খাবার ছিলনা । নদীর পাড়ে আমরা ভারতীয় মিত্রবাহিনীর দেখা পাই । তাদের সহযেগিতায় আমরা শুভপুর নদী পেরিয়ে মিরেরসরাই পৌঁছে যাই । ডিসেম্বর মাসে এখানে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয় । পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করে । আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত হবার পর যতদূর মনে পড়ে ১৯ ডিসেম্বর আমরা চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে পৌঁছেছিলাম ।বিজয়ের আনন্দে সেদিন হাজার হাজার মানুষ আমাদের অভিবাদন জানিয়েছিল ।সে এক অন ̈রকম ভাল লাগার দিন ।গর্বের দিন ।কত পিতা মাতা ভাইবোন সন্তান শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের ষ¦াধীনতা । আমি সেই ইতিহাসের সৈনিক , একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী ।
বেড়ে ওঠা : যুদ্ধশেষে বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশমত আমরা পড়াশোনায় ফিরে যাই ।যুদ্ধের আগে আমি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এস এস সি শেষ করেছিলাম । যুদ্ধের পর চট্টগ্রাম আর্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ,১৯৭৯ সালে চট্টগধাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ শেষ করে ১৯৮১ সালে ডেনমার্ক থেকে মিউজিক ও ফাইন আর্টসে,১৯৮৩ সালে সুইডেনের আপসালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিউজিকে ও ১৯৮৫তে নৃবিজ্ঞানে ডিগ্রী নেবার পর মিউজিকে ভারতের খায়েরাগড় বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী নিয়েছি ১৯৯৪ সালে।
চট্টগ্রামের কবি ও সাংবাদিক, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দৈনিক জমানা, মাহবুবুল আলমের সন্তান সাজেদ । ১৫ ভাইবোনের সবার ছোট সাজেদ ।বড়ভাই সাবিউল আলম চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ , লিবারেল আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহিত উল আলম তার বড়ভাই । সাজেদ মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের জনগ্রিয় সোলস ব্যান্ড গ্রুপ গড়ে তোলেন । পড়াশোনার ফাশাপাশি ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুওে সেতার ,গিটার, ইলেক্ট্রিক গিটারসহ ৩০ রকমের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুর সাধনা করেন ।ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত শেখেন আচারিয়া শ্রী ,পন্ডিত বিমলেন্দুমুখার্জী ,জামালউদ্দিন ভারতিয়া, রোশান জামাল , অসিত ব্যানার্জী,রায়ভান সিং, ভাদরি মহারাজ এর নিকট।
তিনি ভারতীয ঐতিহ ̈বাহি ফিউশন মিউজিক ছাড়াও নাচোকানো,জিওভান্নি ,হিদালগো,উইলিয়ান সিপেদা,আমোরস ,ওমর সোসার সংগে বিভিন্ন সুরের শোতে অংশ নিয়েছেন । তদুপরি সুইডেনের রাজা ও মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর শোতে অংশ নেয়া ছিল তার খ্যাতিমান কাজ ।
সর্বোপরি ডিসকোগ্রাফির উল্লেখযোগ্য শো হচ্ছে: রাগ মারওয়া (১৯৯৩) দিদি প্রডাকসন সুইডেন , ২০০১ সালে টেপ টোনার্ট : প্রেম ,বাসানা: রাগ ওহির ক্সভরব,২০০৪ সালে স্পেনে তিনাজাস উইথ আমোরস ,২০০৫ সালে স্পেনে স্টুডিও প্রডাকসন ওলগা মার্টিনেজের সংগে , ২০০৬ সালে স্পেনে নেলসন ম্যান্ডেলা ̄স্বরণে ওয়েসিস প্রডাকসন ,২০০৯ সালে স্পেনে ,রাগ রাগেশ্রী লাইভ ,২০১০ রাগ মেঘ,লাইভ ,মালাগা ,২০১১সালে রাগ পূরবী, লাইভ কাসতিলন ,২০১২সালে রাগ পিলু ,লইভ ,এক্সকোজাদর, গ্রান্ড থিয়েটার লাইভ রাগ বাসান্ত মুখারি ,ফেইস অব দ্যা স্প্রীং ।
এরপর কিরওয়ানি অর্কেস্ট্রার মিউজিকের সূচনায় জাজ ফেস্টিভ্যাল ২০১২, আলতামিরায় গ্লোবাল ভিলেজ ২০১৩ ,বিশ্ব সুর উৎসব প্লাসিও ডি আলতামিরায় কিরওয়ানির শো ২০১৪ ।
কিরওয়ানি অর্কেস্ট্রা : সাজেদ ২০১০ সালে স্পেনে গড়ে তুলেছেন “কিরওয়ানি অর্কেস্ট্রা”। এটি সমসাময়িক জাজ গ্রুপ । যারা পাশ্চাত্য ও ভারতের সুরের যাদু নিয়ে সাধনা করে যাচ্ছে । ৬জনের এ দলটি গিটার ,সাকসাফোন,দ্যা বাছ, ড্রামস ,সেতার ,তবলা ব ̈বহার করে । বিভিন্ন দেশের সুরের সংমিশ্রণে তারা শো করে থাকে ।এখন তারা সুইডেন ,স্পেন, ভারত ,বাংলাদেশ ,কলাম্বিয়া ,বধাজিলের সুরের মুর্ছনায় ইউরোপ , আমেরিকা ,বাংলাদেশে ঝড় তুলেছেন । ২৪মার্চ ২০২১ এসপেনের দুলছে কাসেদা মাগারো তে কিরওযানি অর্কেস্ট্রার শোতে বহু দর্শক উপস্থিত ছিলেন।
দলে রয়েছেন : সাজেদুল আলম (সেতার,তবলা, ঘাতম, কী বোর্ড,বেরিমবাও ,গিটার, কাটওয়ে , নাইলন স্ট্রিং) বাংলাদেশ , জোয়ন ফনফিরিয়া (গিটার ,সেতার স্পেন ,জেসাস গালার্দো( ড্রামস)স্পেন , এনরিকো মারলিন (গিটার ) ইতালি , আন্দ্রেস মরিসিও বেদোয়া( বাছ ) কলাম্বিয়া , অগােস্তো সিজার লিমা(সাকসাফোন ) ব্রাঝিল । ডোলকা বেলাস আর্টস এস এল,সি/হিলারিওন এসলাভা ৭,০৩২০১এলচি ,স্পেন ।এ ঠিকানায় তাদের স্টুডিও কার্যালয় ।